<p>সম্প্রতি বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলে উচ্চ মাত্রায় মিথেন গ্যাসের ধোঁয়া শনাক্ত করেছে একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা। জিএইচজিস্যাট এবং কায়রোস এসএএস স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত মানচিত্রে মিথেনের উৎস নিশ্চিত না হওয়ায় বিষয়টিকে ‘রহস্যময়’ বলে উল্লেখ করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ। যদিও স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাপ করা সম্ভব, তবে এ রিপোর্টটি সামগ্রিকভাবে গ্রহণযোগ্য তথ্য হিসেবে গৃহীত নয়। প্রযুক্তি ব্যবহার করে আকাশে উলম্ব প্রফাইলে গ্রিনহাউস গ্যাসের ঘনত্ব পরিমাপ করা সম্ভব। তাদের রিপোর্টে বাংলাদেশের আকাশে মিথেনের কয়েকটি সম্ভাব্য উৎসর কথা বলা হলেও এসব উৎসর পরিমাণ ও ব্যাপ্তি বাংলাদেশের তুলনায় পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে বহুগুণ বেশি, যেখান থেকে বাংলাদেশের তুলনায় বহুগুণ বেশি মিথেন উৎপন্ন হয়। </p> <p>মিথেন গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইড অপেক্ষা ২৭ গুণ বেশি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস। বায়ুমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের প্রাকৃতিক উৎসগুলোর মধ্যে জলাভূমি (ওয়েট ল্যান্ড) ডোবা-নালা, ময়লার ভাগাড় (ল্যান্ড ফিল), জৈব আবর্জনার স্তূপ, গৃহপালিত পশু, মলমূত্র ব্যবস্থাপনা, কয়লার খনি, গ্যাসপাইপ লাইনের ছিদ্র বা ফাটল ও ধানক্ষেত অন্যতম।</p> <p>কৃষিজমি থেকে সারা বিশ্বে যত মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড উৎপাদিত হয় তার যথাক্রমে ১৯ এবং ১১% আসে ধানের জমি থেকে ইউএসইপিএ-২০০৬ ও আইপিসিসি-২০০৭)। সুতরাং বলা যায়, ধানক্ষেত থেকে যে পরিমাণ মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড উৎপন্ন হয় তা বৈশ্বিক উষ্ণতায় জোরালো ভূমিকা রাখছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে বৈশ্বিক উষ্ণতায় বাংলাদেশের ধানের জমি থেকে উৎপাদিত মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের ভূমিকা কতটুকু আছে সেটা মূল্যায়ন করার মতো ডাটা আমাদের নেই। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে আমাদের কৃষি সেক্টরের প্রকৃত ভূমিকা জানতে হলে ধানক্ষেত থেকে মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড উৎপাদনের প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত জানা অতীব জরুরি। আমাদের নিজস্ব পরিমাপকৃত ডাটা থাকলে অন্যের চাপিয়ে দেওয়া দায় এড়ানো সম্ভব এবং জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হিসেবে আমাদের যৌক্তিক প্রাপ্তি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তুলে ধরতে পারব। এভাবে সম্ভাব্য সব সেক্টরের সম্মিলিত নিজস্ব ডাটা দিয়ে জাতীয় ডাটাবেইস তৈরি করে আমাদের বিভিন্ন সেক্টর থেকে প্রকৃতপক্ষে কতটুকু গ্রিনহাউস ব্যয় নিঃসরণ হয় তার পরিমাণ বের করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া এই ডাটা আইপিসিসির মডেল ব্যবহার করে প্রস্তুতকৃত ডাটার সত্যতা যাচাই করতে ব্যবহার করা যাবে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।</p> <p>বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মতে, খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে ধান উৎপাদন আরো প্রায় ৪০ শতাংশ বাড়াতে হবে। বিশ্বের মোট উৎপাদিত ধানের ৯০ শতাংশ এশিয়ায় উৎপাদিত এবং এর ৯০ শতাংশ আবার এশিয়ায়ই খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। একদিকে যেমন ধান উৎপাদনের ফলে মাটি থেকে মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড নামক দুটি গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদন ও নিঃসরণ হয়, যা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। অন্যদিকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ধান উৎপাদনের ওপর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ প্রায় ১১ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়। এই বিপুল পরিমাণ জমিতে ধান উৎপাদনে মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড কী পরিমাণে উৎপাদন হচ্ছে তা পরিমাপ করা জরুরি।</p> <p> </p> <p><strong>ধানক্ষেতে কিভাবে মিথেন উৎপন্ন হয়</strong></p> <p>ধানক্ষেতে মিথেন উৎপাদন নির্ভর করে তাপমাত্রা, ধানের জাত, জমি কর্ষণ, বৃষ্টিপাত, সেচ, রাসায়নিক সার ও জৈব সারের ব্যবহারের ওপর। মাটিতে জলাবদ্ধতার কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর মিথেন উৎপাদন শুরু হয়। মাটির জলাবদ্ধতা মাটি থেকে মুক্ত অক্সিজেনকে সরিয়ে দেয়। ফলে মাটিতে থাকা মিথেন উৎপাদনকারী ব্যাকটেরিয়ার এবং অন্যান্য মেটাবলিক (বিপাকীয়) ব্যাকটেরিয়া দ্বারা জৈব পদার্থের ফারমেন্টেশন (গাঁজন) করে মিথেন উৎপাদনে সাহায্য করে। কাজেই মিথেন উৎপাদনের পরিমাণ নির্ভর করে প্রথমত মাটিতে পচনযোগ্য জৈব পদার্থের পরিমাণের ওপর। ফলে পচনকৃত বা কম্পোস্টেড জৈব পদার্থের তুলনায় পচনযোগ্য জৈব পদার্থ অনেক বেশি মিথেন উৎপাদন করে। ধানের বৃদ্ধিকালীন ধানের মূল থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব উপাদান নিঃসৃত হয়, যা মিথেন উৎপাদনকে বৃদ্ধি করে। আকাশে মেঘ কম থাকলে, বৃষ্টি না হলে বা সূর্যের আলো বেশি হলে সালোক সংশ্লেষণ বেশি হবে এবং মূলের জৈব উপাদান নিঃসরণ বেশি হবে, যা মিথেন উৎপাদনকে বৃদ্ধি করে। এ জৈব রস নিঃসরণ আবার ধানের মূলের পরিমাণও জাতভেদে বিভিন্ন হতে পারে। মাটিতে উৎপাদিত মিথেন ব্যাপনের মাধ্যমে, বুদ্বুদের মাধ্যমে এবং মূলের মাধ্যমে ব্যাপিত হয়ে ধানগাছের অ্যারেনকাইমা কলার সাহায্যে বাতাসে নিঃসরণ হয়। অন্যদিকে মাটিতে উৎপাদিত মিথেন পুনরায় মিথেন উৎপাদনকারী ব্যাকটেরিয়া দ্বারা জারিত হয়ে কার্বন ড্রাই-অক্সাইডে পরিণত হতে পারে। কখনো কখনো মিথেন, অ্যামোনিয়াম অক্সিডাইজিং (জারণ) ব্যাকটেরিয়া দ্বারাও জারিত হতে পারে। এ দুই গ্রুপ ব্যাকটেরিয়ার জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন।</p> <p>আবার মাটিতে মিথেনের উৎপাদন ও জারনপ্রক্রিয়া মাটিতে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানের ওপরও নির্ভর করে। কারণ এসব পুষ্টি উপাদানের ওপর নির্ভর করে গাছের বৃদ্ধি, মিথেন উৎপাদনকারী ব্যাকটেরিয়ার কার্যক্রম, ধানের মূলের বৃদ্ধি ও পরিমাণ এবং মূল রস নিঃসরণ, যা সালোক সংশ্লেষণ ও অক্সিজেনের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে মিথেন নিঃসরণকে প্রভাবিত করে। মাটিতে মিথেন উৎপাদন নাইট্রেট দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং নাইট্রেট বেশি হলে মিথেন উৎপাদন কম হতে পারে। অনুরূপভাবে মাটিতে আয়রন, সালফার, সালফায়েড, অ্যামোনিয়াম ইত্যাদির পরিমাণ মিথেন উৎপাদনকে প্রভাবিত করে। অ্যামোনিয়াম মাটিতে মিথেন অক্সিডেশনকে কমিয়ে মিথেন নিঃসরণকে বৃদ্ধি করে।</p> <p>এই বছর ধানের জমি বা বদ্ধ জলাশয়, যেখানে পর্যাপ্ত পচনযোগ্য জৈব পদার্থ রয়েছে সেখান থেকে মিথেন উৎপাদনের উপযুক্ত পরিবেশ ছিল। এ বছর যথাসময়ে বৃষ্টি না হওয়া এবং ধানের ফুল আসার সময় অতিরিক্ত তাপমাত্রা থাকা মিথেন উৎপাদনের অনুকূলে ছিল। কারণ বৃষ্টির পানি জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহকরত মাটির তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে। একই সঙ্গে উচ্চ তাপমাত্রার কারণে দাবদাহের এ বছর ধানে প্রচুর চিটা দেখা যাচ্ছে, যেটা অতিরিক্ত মিথেন উৎপাদনের সম্ভাবনাকে প্রমাণ করে। তা ছাড়া বৃষ্টি না থাকায় সূর্যরশ্মির বিকিরণ বেশি ছিল, যা সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে গাছের মূলের বৃদ্ধি বাড়িয়ে বেশি মিথেন তৈরি করতে পারে।</p> <p> </p> <p><strong>করণীয় </strong></p> <p>ধানের জমিতে মিথেন উৎপাদন কমানোর জন্য দু-তিনবার জমি থেকে পানি নিঃসরণ (বিশেষ করে যখন প্লাবিত করে রাখা অপরিহার্য নয়), ধানের জাত নির্বাচন, যেসব জাতের মূলের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম বা মিথেন ট্রান্সলোকেশন ক্ষমতা কম), নাইট্রেট বা সালফেট জাতীয় সারের ব্যবহার, কম্পোস্টেড জৈব পদার্থ সরবরাহ, পচনযোগ্য জৈব পদার্থ কম সরবরাহ এবং কৃষি সুরক্ষা পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে জমি যতটা সম্ভব কম কর্ষণ করা।</p> <p>কৃষিপ্রধান এ দেশে যেখানে সারা বছর ধরে কৃষিজাত দ্রব্য উৎপাদিত হয় সেখানে ধানের পাশাপাশি অন্যান্য ফসল থেকেও মিথেন উৎপাদন হয় কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার।</p> <p>মিথেন গ্যাস শুধু গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়াই করে না, জৈব বৈচিত্র্য ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।  উচ্চ মাত্রার মিথেন একদিকে যেমন দ্রুত বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে বন্যা, খরাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডেকে আনছে, তেমনি ক্ষতিকারক পোকা-মাকড়ের বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষ, পশু-পাখি ও ক্ষেতের ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। তাই মিথেন গ্যাসের সম্ভাব্য উৎসগুলো চিহ্নিত করে প্রতিকারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি। অন্যথায় প্রকৃতি ও পরিবেশ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।</p> <p> </p> <p> লেখক: অধ্যাপক, মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ</p> <p> </p>