মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর ক্যুর বিরুদ্ধে যে সাহসিকতাপূর্ণ প্রতিবাদ হচ্ছে তাতে রহস্যময়, বিক্ষিপ্ত এবং পরিচিত কিছু বিষয় রয়েছে। তাদের প্রতিবাদে পূর্ববর্তী কালের সেনাবিরোধী প্রতিরোধের ঔদ্ধত্য ও অমান্য করার দৃঢ়তা রয়েছে—তাদের প্রতিবাদে সেসবের প্রতিধ্বনি রয়েছে। সেসব বিষয় সচেতন মনে আরো অনেক কিছুর উদ্রেক করে, আরো অনেক দৃশের অবতারণা ঘটায়, যা হাজার মাইলেরও বেশি দূরে অনুরণিত হয়।
যারা ফ্রন্টলাইনে আছে তাদের হেলমেটে, আর পেছনের ওয়ালগুলোতে বিক্ষিপ্ত বর্ণাঢ্য স্লোগান, বর্ণাঢ্য নোট—হঠাৎ উদয় হওয়া লোকজনের মিছিল বা আন্দোলনের কর্মীদের প্লেবুক থেকে সোজা রাস্তায় নেমে এসেছে এসব স্লোগান, নোট। হংকংয়ে ২০১৯ সালে এমনটি ঘটেছিল—সত্যিই। বার্মিজ ভাষায় অনূদিত ট্যাকটিকসের একটা ম্যানুয়াল সোশ্যাল মিডিয়ায় হাজারবারেরও বেশি শেয়ার করা হয়েছে।
থাইল্যান্ডেও একই পরিস্থিতি, সেখানে গণতন্ত্রপন্থী প্রতিবাদকারীরা রাজতন্ত্রের সংস্কার দাবি করেছে এবং প্রধানমন্ত্রীর অপসারণ দাবি করেছে—প্রধানমন্ত্রী কার্যত ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এখানেও হংকং প্রতিবাদের প্রভাব দৃশ্যমান—হ্যান্ড সিগন্যালের ব্যবহার, কোনো পার্টিকুলার অ্যাকশন করা হবে কী হবে না তার জন্য ভোটগ্রহণ ইত্যাদি। এটা শুধু একটা এশীয় প্রপঞ্চ নয়। নিরাপত্তাকর্মীরা টিয়ারগ্যাস ছুড়ে মারতে গেলে বেলারুশের বিক্ষোভকারীরাও ছাতা মেলে ধরেছে। লেবাননের বিক্ষোভকারীরাও টেনিস র্যাকেট ব্যবহার করেছে ছুড়ে মারা টিয়ারগ্যাসের ক্যানেস্তারা ঠেকানোর জন্য বা উল্টো নিরাপত্তাকর্মীদের দিকে ছুড়ে মারার জন্য।
ক্র্যাকডাউনে হংকংয়ের রাস্তাগুলো নীরব হয়ে গেছে। গত বছর ন্যাশনাল সিকিউরিটি ল নামের একটি তুঘলকি আইন জারি করে প্রতিবাদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে। এর পরম্পরায় চটজলদি প্রচুর লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার পরও সেই আন্দোলন, যা খুব দ্রুত শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, তা মজার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে—সারা দুনিয়ার অ্যাক্টিভিস্টরা সেখান থেকে শুধু বিশেষ কিছু ট্যাকটিকসই শেখেনি, তারা তাদের মতো করে অজ্ঞাত থাকার, দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার স্বতঃস্ফূর্ত, নমনীয় কায়দা রপ্ত করেছে, গা এড়িয়ে চলার কায়দা শিখেছে, দ্রুত প্রতিবাদ জানিয়ে সটকে পড়ার কায়দা রপ্ত করেছে। তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে সংগঠন পরিচালনার টেকনিক শিখেছে।
হংকংয়ের বিক্ষোভকারীরা খুব ঘনিষ্ঠভাবে তাইওয়ানের সানফ্লাওয়ার মুভমেন্টের দিকে খেয়াল করেছে, সেটা ২০১৪ সালের কথা। ইউক্রেনের ময়দানের বিক্ষোভের ঘটনাবলিও লক্ষ করেছে তারা—এসবের মধ্যে তারা বাইবেলের ডেভিড এবং গোলিয়াথের কাহিনির একটা অনুরণন দেখতে পেয়েছে। এর মধ্যে কোনো নতুনত্ব নেই—এক গণবিক্ষোভ থেকে আরেক গণবিক্ষোভে প্রেরণা পাওয়ার বিষয় থাকেই; এমনকি অনেক দূরবর্তী স্থানে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটলেও, যেমন আমেরিকায় যখন বিপ্লব ঘটল তখন তা ফ্রান্সের বিপ্লবেও ইন্ধন জোগাল।
পার্থক্যটা হচ্ছে প্রচণ্ড গতি, এখন আইডিয়া বা ধারণা প্রচণ্ড বেগে সঞ্চারিত হয়। আগের দিনে লম্বা নৌকাভিযান বা ট্রেনভ্রমণ দরকার হতো পারস্পরিক যোগোযোগের জন্য। এখন সমমনাদের যোগাযোগের কায়দা বদলেছে, এখন তারা অনলাইনের মাধ্যমেই যোগাযোগ করতে পারে।
আরব বসন্তের শুরু হয়েছিল তিউনিসিয়ায়, কিন্তু তার জোরালো প্রতিধ্বনি ছড়িয়েছে অনেক দূর পর্যন্ত। যখন মিসরের সামরিক জান্তা উল্টে গেল, তখন মিয়ানমারের লোকজন এর থেকে শিক্ষা নিয়েছিল। এখন হংকং, তাইওয়ান এবং থাইল্যান্ডের অ্যাক্টিভিস্টরা খুব দ্রুত মিয়ানমারের অ্যাক্টিভিস্টদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাদের ‘মিল্ক টি অ্যালায়েন্স’-এ যোগ দেওয়ার জন্য। তারা ফুটেজ ছড়িয়েছে, বিশ্বব্যাপী মেসেজ শেয়ার করেছে; তারা বেলারুশের বিক্ষোভকারীদের সঙ্গেও একই কাজ করেছে।
প্রতিবাদকারীরা যদি মেসেজিং অ্যাপ যেমন টেলিগ্রাম সিকিউর করে থাকে, তারা যে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে তাদেরও সুরক্ষিত ও সুগঠিত সারভেইলেন্স নেটওয়ার্ক আছে, তাদের বৃহদাকার নিরাপত্তা বাহিনীও আছে, অস্ত্র-সরঞ্জাম-প্রযুক্তি কেনার মতো প্রচুর সম্পদও আছে। দ্রুত ও সহজে চলায় তাদের সমস্যা কী? তারা ধারণার চেয়েও বেশি প্রস্তুত ক্ষমতার জন্য, তাদের কাছাকাছি যে সম্পদ আছে তা পাওয়ার জন্য। পরস্পরকে কী করে সমর্থন জোগাতে হয়, পরস্পরের কাছ থেকে কী করে শিক্ষা নিতে হয় তা তারা জানে। পৃথিবীর কোথায় কিভাবে আন্দোলন থামাতে সে বিষয়গুলো তারা স্টাডি করে দেখে; জাতিংসংঘে ডিপ্লোমেটিক কভার অফার করে এবং কী করে দমাতে হয়, নিপীড়ন করতে হয় তার সফটওয়্যার ও উইপনের বাণিজ্য বা লেনদেন করে।
এখন যে প্রতিবাদের ঢেউ দেখা যাচ্ছে এবং এক দশক আগে যে প্রতিবাদ হয়েছে তার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, মূলত অ্যক্টিভিস্টরা গ্রেটার ফ্রিডম এখন চাচ্ছে না, বরং যে ফ্রিডম বা স্পেস তাদের আছে তা রক্ষা করার জন্য লড়ছে—বর্ধমান কর্তৃত্বপরায়ণতার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য লড়াই করছে। কর্তৃত্বপরায়ণতা বিশ্বজুড়েই বেড়েছে। ১০ বছর চলছে, আরব বসন্তের প্রায় সব গণ-অভ্যুত্থানই শেষ হয়েছে যুদ্ধে অথবা আরো বেশি নিপীড়ন ও নিষ্ঠুর শাসনে। নীতিহীন সরকারগুলো মহামারিকে কাজে লাগিয়েছে নিয়ন্ত্রণ আরো কঠোর করার জন্য।
দশকের পর দশক স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের পর যেখানে ক্যাম্পেইনাররা স্বাধীনতার নতুন বাস্তবতার সন্ধান করে, সেখানে এখন তাদের অনেকেই খুব খুশি হবে যদি তারা কিছুদিন আগেও যে স্বাধীনতা ছিল তা পুনরুদ্ধার করতে পারে। তারা কম প্রতিবাদ করে আশা থেকে নয়, ধারণা থেকে। তারা মনে করে যে তাদের অন্য সুযোগ কিছু হলেও আছে। তারা যখন তাদের ধারণা নিয়ে নড়াচড়া করে, প্রযুক্তি নিয়ে ভাবে, তখন তারা শুধু কমনসেন্সই দেখতে পায় না, বরং তারা তাদের লড়াইয়ে অর্থসঞ্চার করে, প্রাণসঞ্চার করে; এমনকি তাদের গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলেও। প্রতিরোধের শিখা প্রজ্বলিত রাখতে গিয়ে তারা আশা করে—কোথাও, কখনো এটা নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার পথ দেখাবে।
সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান ইউকে
ভাষান্তর : সাইফুর রহমান তারিক
মন্তব্য