<p>১৯৬৯ সালের ২১ মার্চ আমার জীবনের এক অসাধারণ স্মৃতিময় দিন। সেদিনই আমি প্রথম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কাছ থেকে দেখি। জনসভা মঞ্চে স্কুলপড়ুয়া বালকের বঙ্গবন্ধুর কাছে যাওয়ার স্মৃতি, তাঁর সস্নেহ স্পর্শের উত্তাপ আমার জীবন অভিজ্ঞতার সমুজ্জ্বল এক অংশ।</p> <p>বঙ্গবন্ধু সেদিন আদমজীনগরে এসেছিলেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে তিনি মুক্তি লাভ করেন ২২ ফেব্রুয়ারি। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ছাত্র-জনতার সংবর্ধনা সমাবেশে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১০ মার্চ বঙ্গবন্ধু রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন। ১৪ মার্চ তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায় ফিরে ঢাকার বাইরে তিনি প্রথম জনসভা করেন আদমজীনগরে।</p> <p>আমরা তখন থাকতাম আদমজী জুট মিলের জুনিয়র অফিসার্স কোয়ার্টারের (জেও কোয়ার্টার) ২৮ নম্বর বাসায়। আমার বাবা প্রয়াত আহমদ হোসেন চৌধুরী ছিলেন আদমজী জুট মিলের শ্রম ও কল্যাণ কর্মকর্তা।</p> <p>জনসভার স্থান নির্বাচন করা হয় মুনলাইট সিনেমা হলের পেছনে খালি জায়গায়। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, কানায় কানায় পূর্ণ মাঠ, ঢাকা, ডেমরা থেকে শুরু করে আদমজী জুট মিল, গোদনাইল, ঢাকেশ্বরী কটন মিল, লক্ষ্মী নারায়ণ কটন মিলসহ নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মাধবদী, ঘোড়াশাল ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সমবেত হয়েছিল লাখ লাখ মানুষ। আদমজীনগরে আসার পথে জনতা বঙ্গবন্ধুকে অভূতপূর্ব সংবর্ধনা জানায়।</p> <p>পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি সাইদুর রহমান আদমজীনগরের এই ঐতিহাসিক জনসমাবেশে সভাপতিত্ব করেন। সভার শুরুতে ৭২টি শ্রমিক, ছাত্র ও আওয়ামী লীগ শাখার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিপুলভাবে মাল্যভূষিত করা হয়। আদমজী মিল শ্রমিকদের পক্ষে মাল্যদান করেন মওলানা সাইদুর রহমান। জনসভায় সোনারগাঁ জিআর ইনস্টিটিউশনের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ১০ বছরের মহিউদ্দিন শেখ মুজিবকে এক হাতে মাল্যভূষিত করে। গণ-আন্দোলনের সময় সোনারগাঁয় কনভেনশন লীগ দলের চিফ হুইপের বাড়ির সামনে মহিউদ্দিন বাঁ বাহুতে গুলিবিদ্ধ হয়। শেখ মুজিব তাকে আদর করে নিজের গলা থেকে একটি মালা এবং আরো দুটি মালা তার গলায় পরিয়ে দেন। গোদনাইল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ছয় দফার প্রতীক একটি স্বর্ণতারকা এবং সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ছয় দফার আরো একটি স্বর্ণতারকা উপহার দেওয়া হয়। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার হাউসের পক্ষ থেকে মানপত্র প্রদান করা হয়। আদমজী জুট মিল সংযুক্ত শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কোরআন শরিফ ও একটি রুপার তলোয়ার উপহার দেওয়া হয়। আদমজী শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ছয় দফার প্রতীক ছয়টি কপোত বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেওয়া হয় এবং তিনি সেগুলোকে মুক্ত আকাশে উড়িয়ে দেন।</p> <p>চট্টগ্রামের বিপ্লবী গায়ক শফিউদ্দিন উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করেন। জনসভায় মোহাম্মদ খান ছয় দফার সংগীত পরিবেশন করেন। নারায়ণগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগের সদস্য কফিল উদ্দিন আহমেদ সভার মানপত্র পাঠ করেন। ঐতিহাসিক এই জনসভায় আরো বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী, ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুর রউফ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদ, নারায়ণগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান, চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান, নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল হক এমপি, গণসমাবেশের প্রস্তাবাবলি পাঠ করেন সিরাজুল আলম খান।</p> <p>বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন বক্তৃতার জন্য উঠে দাঁড়ান তখন পাঁচ মিনিট বিপুল করতালি ও স্লোগানের মধ্যে নেতার ওপর চারদিক থেকে সমানে পুষ্প ও মাল্যবৃষ্টি হতে থাকে। বক্তৃতার শুরুতে বঙ্গবন্ধু সাম্প্রতিক সময়ে গণ-আন্দোলনে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁদের স্মরণ করেন।</p> <p>দেশবাসীকে ছয় দফা কর্মসূচি উপহার দেওয়ার পর নিজের ওপর যে জেল-জুলুম ও অত্যাচারের অভিশাপ নেমে আসে, তার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে যখন শুনলাম, ছয় দফা আন্দোলনে নেমে আমার মা, ভাই ও বোনেরা রাজপথে পুলিশ-মিলিটারির গুলিতে প্রাণ দিয়েছে, বিশ্বাস করুন, ভাইসব, তখন এক মুহূর্তের জন্যও ঘুমাতে পারি নাই। অসহ্য বেদনায় বুক আমার ভারাক্রান্ত হয়েছে, এই জন্যই কি তবে পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করেছিলাম?’ পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকের অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু দুঃখ করে বলেন, ‘কোনো কোনো নেতার স্বার্থপরতার ও সংকীর্ণ চিন্তাধারার দরুন স্বায়ত্তশাসন ও এক ইউনিটের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত আমরা গ্রহণ করতে পারি নাই। কিন্তু এ অবস্থা আর বেশিদিন চলবে না। জনগণ নিজেদের শক্তিতে এই দুই প্রশ্নের সমাধান ছিনিয়ে আনবেই। এই দাবি দাবাইয়া রাখা কারো পক্ষে আর সম্ভব হবে না।’</p> <p>ছাত্র-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের দাবি-দাওয়ার প্রশ্নে তিনি ঘোষণা করেন, ‘জনগণের দাবিদাওয়া আদায় না হওয়া পর্যন্ত দিনের আরাম ও রাতের বিশ্রাম আমার জন্য হারাম। দেশবাসীকে আমি এই আশ্বাস দিচ্ছি যে আমি এককথার মানুষ, আমার দেশের ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-জনতার ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য আমার সংগ্রামী সহকর্মী ও ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-জনতার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমি সংগ্রাম চালিয়ে যাব। সুস্পষ্টভাবে আমি দেশবাসীকে জানিয়ে দিতে চাই, আমাদের সংগ্রাম চলবে দুইভাবে—জনগণের ভোট আর গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে।’</p> <p>এই জনসভায় আব্বা আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে ওঠার পর তিনিও আমাদের নিয়ে মঞ্চে ওঠেন এবং বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে আমাদের দুই ভাইকে পরিচয় করিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর গলা থেকে মালা নিয়ে দুটি মালা আমাদের গলায় পরিয়ে দেন। আমাদের চুমু দিয়ে আদর করেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। তারপর তাঁর সামনে থেকে অনেকগুলো মালা নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বলেন, ‘এগুলো সব তোমার।’ আমি আনন্দ, উত্তেজনা ও গভীর শ্রদ্ধায় মালাগুলো নিয়ে মঞ্চের এক পাশে বসে পরি। কী যে আনন্দ আজ ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না! কিন্তু সব কটি মালা আমি ধরে রাখতে পারিনি। মঞ্চে অনেকে ছিলেন, আমাকে একটি দাও—আমাকে একটি...এভাবে একেকজন একেকটি মালা নিয়ে যান। দুটি মালা আমি অনেক কষ্টে ধরে রাখি। জনসভা থেকে ফেরার পথে আরেকটি মালা যে কখন খোয়া যায়, আজ মনে নেই। বাসায় ফিরে দক্ষিণ দিকের কক্ষের পশ্চিম দিকের দেয়ালে সেই মালাটি আমি ঝুলিয়ে রাখি আমার জীবনের অনন্য এক প্রাপ্তি হিসেবে।</p> <p>বঙ্গবন্ধুকে এর পরে আরো দেখেছি। তবে এভাবে কাছে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়নি। জনসমুদ্রে উপস্থিত থেকে তাঁর অনেক ভাষণ শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ, ১০ জানুয়ারির ভাষণ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ—সেসব সভায় উপস্থিত থেকে শুনেছি। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে তিনি আবারও আদমজী জুট মিলে গিয়েছিলেন, তখনো হাজার হাজার শ্রমিকের আবেগাপ্লুত সংবর্ধনায় তাঁকে দেখেছি।</p> <p>কিন্তু ২১ মার্চের সেদিনের স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ক্ষণিকের জন্য হলেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য পাওয়ার স্মৃতি, তাঁর স্নেহ পাওয়ার স্মৃতি। মানুষের এক জীবনের সব প্রাপ্তি মূল্যবান নয়, কিছু প্রাপ্তি থাকে যা রোমন্থনের, গৌরবের ও আনন্দের। বঙ্গবন্ধুর স্নেহের অনন্য আলোকসম্পাতে আমার কিশোরবেলা গৌরবান্বিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্কুলপড়ুয়া বালকের হাতে তুলে দিয়েছিলেন মালা। মালাটি হারিয়ে গেছে; কিন্তু সৌরভ হারায়নি আজও। আমার স্মৃতিতে চির অম্লান সেই দিন, মনে হয় এখনো দাঁড়িয়ে আছি কৈশোরের সেই বিকেলবেলায়, আদমজীর জনসভায়, স্মৃতিকথা লিখছি হৃদয়ে, লিখছি অবিরত।</p> <p><strong>লেখক : </strong>কবি, প্রধান সমন্বয়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষকী উদ্‌যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি</p>