<p>নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে বৈরুতের বন্দরে যে ডিজিটাইজেশন চলছিল, তাতে আমার অংশগ্রহণ ছিল। তখন আমি কিশোর। ওই কর্মসূচিতে শিপিং ডাটা এন্ট্রির কাজ করেছি আমি। কাজটা একঘেয়ে হলেও তাতে ছিল আশা।</p> <p>১৫ বছরের গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত লেবাননের অর্থনীতি সে সময় চাঙ্গা হতে শুরু করলেও বন্দরের অবকাঠামোগত অবস্থা ছিল নাজুক। ওই অবস্থায় ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে শুরু হয়েছিল ডিজিটাল পদ্ধতিতে তথ্য সংরক্ষণ প্রক্রিয়া, যেন নিশ্চিত করা যায় শৃঙ্খলা আর জবাবদিহি।</p> <p>ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে যে লেবানন মাথা তুলেছিল, রাজনীতিকদের বিরামহীন ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডে সেই লেবানন শেষ হয়ে গেছে। গত মঙ্গলবার সেই ধ্বংস চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে। বিস্ফোরণে উড়ে গেছে বৈরুতের বন্দর। এবার লেবানন এমন এক ধ্বংসের মুখে পড়েছে, দশকের পর দশক ধরে চলা যুদ্ধ আর রাজনৈতিক অস্থিরতাজনিত ধ্বংসলীলার সঙ্গে যেটার তুলনা হয় না। দেশের পরতে পরতে কয়েক দশকের অব্যাহত দুর্নীতির কারণে বন্দরটা ধ্বংস হয়ে গেল, ধ্বংস হয়ে গেল শহরের বিরাট অংশ, গেল বহু প্রাণ।</p> <p>লেবাননের সরকারি কর্মকর্তা ঘটনা সম্পর্কে মোটামুটি একমত, তবে আরো কিছু বের হবে বলেই মনে হচ্ছে। কারণ এটা তো লেবানন। রাজনৈতিকভাবে, ধর্মীয়ভাবে এবং ঐতিহাসিকভাবে এ দেশে আছে চরম বিভক্তি। তার পরও লেবাননের বিশ্বাসযোগ্য সংবাদমাধ্যমগুলো যা বলছে, সে অনুসারে ২০১৪ সালে এক জাহাজ থেকে দুই হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বন্দরে গুদামজাত করা হয়। গতকাল ওয়েল্ডিংয়ের কাজের সময় অসতর্কতাবশত ওই গুদামের কাছে রাখা আতশবাজিতে আগুন ধরে যায় এবং ওই আগুনই পরে গুদামজাত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটকে বিস্ফোরকে পরিণত করে।</p> <p>রাজনীতিক, অপরাধী আর সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কাছে বন্দরগুলো বরাবরই অন্যতম আকর্ষণীয় সম্পদ। বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা এখানে নিজেদের মতো করে কার্যক্রম চালায়। বন্দরে নিয়োগের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিয়ন্ত্রণ করে রাজনৈতিক অথবা বিভিন্ন গোষ্ঠী। দুর্নীতি, অবহেলা আর দায় চাপানোর সংস্কৃতি এখানে সর্বব্যাপী। এগুলোর পেছনে আছে যে রাজনৈতিক শ্রেণি, তাদের কাছে জনস্বার্থ সব সময় উপেক্ষিত। তাদের অযোগ্যতার কথা না-ই বা বললাম।</p> <p>এত কিছুর মধ্যে ঠিক কোন কারণে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বোমা হয়ে ছয় বছর ধরে বন্দরে বসে ছিল, সেই গুদামের কাছে আতশবাজি রাখার ঘটনা কী করে ঘটল আর কাছাকাছি জায়গায় দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করার ঘটনাই বা ঘটল কী করে, সেসব এখনো অস্পষ্ট। তবে লেবাননের অব্যবস্থাপনাই যে এর জন্য দায়ী, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।</p> <p>বিস্ফোরণের সঙ্গে লেবাননবাসী পরিচিত। সরকারের অব্যবস্থাপনার কারণে সৃষ্ট নানা দুর্ভোগ পোহাতেও অভ্যস্ত এ দেশের মানুষ। তবে বন্দরে বিস্ফোরণের পরিণতি হতাহত আর তাত্ক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ওই বিস্ফোরণে দেশের প্রধান শস্যভাণ্ডার ধ্বংস হয়ে গেছে। সেখানে দেশের চাহিদার ৮৫ শতাংশ শস্য ছিল। ক্ষতিগ্রস্ত বন্দর দিয়ে আর পণ্য আনা যাবে না। লেবাননের ৮০ শতাংশ খাদ্যচাহিদা মেটানো হয় আমদানির মাধ্যমে। আমদানি করা খাদ্যের মধ্যে ৯০ শতাংশ থাকে গম, যা থেকে তৈরি রুটি লেবানিজদের প্রধান খাবার। আর আমদানি করা খাদ্যের ৬০ শতাংশ আসত বৈরুতের বন্দর দিয়ে।</p> <p>এর চেয়ে খারাপ সময় আর হয় না। লেবানন কয়েক মাস ধরে অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে। বছরের পর বছর ধরে দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার কারণে স্থানীয় মুদ্রার মান নিচে নেমে গেছে। শত শত মানুষের কাছে খাবার, ওষুধ আর জ্বালানি কেনার অর্থ নেই। তার ওপর করোনাভাইরাস মহামারি স্বাস্থ্য খাতে চরম চাপ সৃষ্টি করেছে। মঙ্গলবারের বিস্ফোরণের পর আহতদের সেবায় পথে নামতে বাধ্য হয়েছেন সেই স্বাস্থ্যকর্মীরা। বিস্ফোরণের কারণে খাদ্য আর স্বাস্থ্য খাতের যে সংকট দেখা দিতে যাচ্ছে, যুদ্ধের মধ্যেও লেবাননকে তেমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি।</p> <p>সংকটের তাত্ক্ষণিক সমাধানের জন্য লেবানিজদের সাহায্য দরকার। বহির্বিশ্ব থেকে সেই সাহায্য আসছেও বটে। তবে তাতে লেবাননের পতন ঠেকানো যাবে না। বন্দরে বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে গেছে, সভ্য লোকজন এ দেশে আর কখনো নিরাপদে পূর্ণাঙ্গ জীবন যাপন করতে পারবে না।</p> <p>বিস্ফোরণের দৃশ্য দেখে বন্দরে কাজ করার সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। বন্দরটা ধ্বংস হয়ে গেছে। লেবানিজদের জন্য উন্নয়নের পরিবর্তে টিকে থাকাই মুখ্য হয়ে উঠবে।</p> <p> </p> <p>লেখক : সেন্টার ফর গ্লোবাল পলিসির উপপরিচালক, জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি বিষয়ক অ্যাডজাংকট অধ্যাপক</p> <p>সূত্র : নিউ ইয়র্ক টাইমস</p> <p>ভাষান্তর : শামসুন নাহার</p>