<p>অবৈধ পথে ইউরোপের উদ্দেশে প্রায় মাস চারেক আগে লিবিয়ায় যাওয়া ২৬ জন বাংলাদেশি গত ২৮ মে রাজধানী ত্রিপলি থেকে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার দূরের মিজদাহ শহরে ওই দেশীয় পাচারকারীদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন। এ ছাড়া আরো ১১ জন বাংলাদেশি আহত হয়ে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বাংলাদেশিদের ছাড়াও অন্যান্য দেশের নাগরিকও ওই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। মূলত মুক্তিপণকে কেন্দ্র করেই ওই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতায় নিমগ্ন লিবিয়ার এমন এক গোলযোগপূর্ণ স্থানে ওই ঘটনাটি ঘটেছে যে মৃতদেহ দেশে আনা সম্ভব না হওয়ায় ওখানেই দাফনকর্ম সম্পন্ন করতে হয়েছে। এমনকি আহতদের চিকিৎসাও মিজদাহ শহরের হাসপাতালে দিতে হচ্ছে।</p> <p>এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বা মৃত্যু কারো কাম্য হতে পারে না। তবে বিদেশের উদ্দেশে পাড়ি দেওয়া বাঙালিদের জন্য এসব ঘটনা নতুন কিছু নয়, কেউ সাগরে ডুবে মরছে, কেউ বা জীবন দিচ্ছে পাচারকারীদের হাতে। এ ছাড়া অবৈধভাবে অবস্থানের জন্য হাজার হাজার বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশের জেলে সাজা ভোগ করছে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অবৈধ পথে যাওয়ার এ প্রবণতা যেমন বিদেশ গমনেচ্ছুদের মধ্যে রয়েছে, তেমনি তাদের বিদেশে প্রেরণের জন্য একদল লোকও বাংলাদেশে বহু বছর থেকেই সক্রিয় রয়েছে। আর এ দুই দলের সম্মিলন ঘটে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে। বিদেশ যাওয়ার স্বপ্নে এতটাই বিভোর থাকে যে সর্বস্ব ব্যয় করেও চাহিদামতো অর্থ দালালদের দিতে তারা বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করে না। বিদেশ যাওয়ার নেশায় যখন পেয়ে যায়, তখন ভালোমন্দ বিচার করার ক্ষমতাটুকুও তারা হারিয়ে ফেলে। সত্যি বলতে কী, অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার এ প্রক্রিয়াটিকে চালু রাখার পেছনে দুই পক্ষেরই অবদান রয়েছে। এ ছাড়া যেভাবেই হোক কেউ বিদেশে চলে গেলেই যেন ওই পরিবারটি আর্থিক টানাপড়েন থেকে বেঁচে গেল বলে অনেকেই বাধা দেওয়া দূরের কথা; বরং উৎসাহ দিয়ে থাকেন। ওই যাওয়াটা কোন পথে অর্থাৎ বৈধ, না অবৈধ পথে হলো তা কেউ ভাবে না। তারা দেখে আসছে যে অনেকেই অবৈধ পথে ইউরোপ, আমেরিকা গিয়ে বাড়িতে টাকা পাঠাচ্ছে, এমনকি অনেকেই ওসব দেশে স্থায়ীও হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং বৈধ-অবৈধ নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামায় না।</p> <p>এ প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার একটি ঘটনার অবতারণা না করে পারছি না। ২০১১ সালে মালয়েশিয়া সরকার ওই দেশে অবৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশি কর্মীদের বৈধভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ‘৬-পি’ নামে একটি প্রগ্রাম হাতে নেয়। বাংলাদেশের দুই লাখ ৬৭ হাজার ৮০৩ জন কর্মী ওই প্রগ্রামে নিজেদের নিবন্ধিত করে। ভারতের নিবন্ধিত কর্মীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫ হাজার এবং তাদের মধ্যে যারা নিবন্ধনে উল্লিখিত নিয়োগদাতার সঙ্গে সম্পাদিত ‘কর্ম চুক্তি’র কপি পাসপোর্টের আবেদনের সঙ্গে জমা দেয় তাদেরই ভারতীয় দূতাবাস নতুন পাসপোর্ট প্রদান করে। যারা চুক্তি সম্পাদনে ব্যর্থ হয় তাদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। কারণ ভারতের কোনো নাগরিক মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে থাকুক এটি তারা চায়নি। একইভাবে আমরা যখন এই শর্তের কথা বললাম তখন আমাদের লোকজনের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। এমনকি ঢাকা থেকে বলা হলো সবাইকে পাসপোর্ট দিয়ে দিতে। এভাবেই আমরা আমাদের কর্মীদের বৈধভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা দেওয়ার মহৎ উদ্যোগ থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হই। যা ভেবেছিলাম, অবশেষে তাই ঘটেছিল। ওই কর্মীদের প্রায় ৬০ শতাংশই বৈধভাবে কাজ করার সুযোগ পায়নি তিনটি কারণে—ক. নিবন্ধিত নিয়োগকারী চাহিদার অতিরিক্ত কর্মীর নিবন্ধন করায় মালয়েশিয়া সরকার ভিসা দেয়নি, খ. আমাদের কর্মী নিবন্ধিত নিয়োগকারীর কাছে না গিয়ে অন্যত্র কাজ নেয় এবং গ. নিয়োগকারী হিসেবে আউটসোর্সিং এজেন্ট বা দালালের দেওয়া নাম নিবন্ধনের ফলে তারা নিয়মমাফিক ভিসার জন্য আবেদন করতে ব্যর্থ হয়।</p> <p>এ ঘটনা থেকে আমরা দুটি বিষয় বুঝতে পারি। প্রথমটি হচ্ছে নিয়মনীতি বা শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, যা অভিবাসী কর্মীদের বিদেশের কর্মজীবন নির্বিঘ্ন করতে পারে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে দেশের সম্মান তথা নিজেদের আত্মসম্মানকে অক্ষুণ্ন রাখার জন্য আপসহীন থাকা।</p> <p>আমাদের কাছে লিবিয়ার ঘটনাটি নতুন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অবৈধ পথে বিদেশের উদ্দেশে পাড়ি দেওয়া বাংলাদেশি নাগরিকদের ঘিরে এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। কক্সবাজার এলাকা থেকে নৌকায় করে বিদেশে, বিশেষ করে মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ড যাওয়ার পথে অনেকেই সাগরে ডুবে মারা গেছে। এমনকি ইতালির কাছাকাছি পৌঁছেও ভূমধ্যসাগরে অনেক বাংলাদেশির ডুবে মরার ঘটনা আমাদের অজানা নয়। আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার তথ্যমতে, প্রতিবছর মালয়েশিয়ায় এবং ইউরোপে অভিবাসী প্রত্যাশী কয়েক হাজার বাংলাদেশি বঙ্গোপসাগরে বা ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা যায়।</p> <p>এখানে একটি বিষয় বোধ হয় স্পষ্ট করার প্রয়োজন রয়েছে যে আমরা প্রায়ই অবৈধ পথে অভিবাসী হওয়ার প্রচেষ্টাকে মানবপাচারের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলি। অভিবাসনের অবৈধ প্রক্রিয়া মানবপাচারের সংজ্ঞায় পড়ে না। এ ক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় কোনো ব্যক্তি দালালচক্রের মাধ্যমে অবৈধ পথে তার ইচ্ছামতো একটি দেশে প্রবেশ করার চেষ্টা করে থাকে। এ জন্য ওই ব্যক্তি বা তার আত্মীয়-স্বজন নিজেরাই দালালচক্রের হাতে মোটা অঙ্কের অর্থ গুঁজে দেয়। অর্থাৎ অবৈধ আন্তর্জাতিক অভিবাসনের মূলে রয়েছে চাকরিসন্ধান। অন্যদিকে মানবপাচার প্রক্রিয়ায় দালালদের ইচ্ছাই প্রাধান্য পায়, তারা যে গন্তব্য নির্ধারণ করে দেয় সেখানেই পাচারকৃত ব্যক্তিকে যেতে হয়। সাধারণত নারী ও শিশুদেরই পাচারে প্রাধান্য দেওয়া হয়।</p> <p>জানামতে, লিবিয়ার ঘটনার সঙ্গে জড়িত অনেককেই এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং লিবিয়ার সরকারও দোষীদের বিচারের আওতায় আনার আশ্বাস দিয়েছে। যদিও আগে এ ধরনের ঘটনায় জড়িতদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি। তবে এবারের ঘটনায় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ আমাদের কিছুটা আশান্বিত করেছে। জানি না ভবিষ্যতে কী হবে। তবে আমরা চাই না এসব ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি হোক। মানবপাচার হোক বা পাচারকারীদের সহায়তায় অবৈধ পন্থায় অভিবাসী হওয়ার চেষ্টা করা হোক—এগুলো বন্ধ করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। কারণ এর মূলে যে দুটি পক্ষ সরাসরি জড়িত সেখানে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও জনগণকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এসব বন্ধে আমাদের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।</p> <p>এই ভয়াবহ পরিণতি রোধে আমরা নিম্নে বর্ণিত বিষয়গুলোর কথা ভাবতে পারি—১. এসবের ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা। জাতীয় প্রচারমাধ্যমগুলো এবং সুধীসমাজ এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারে। ২. সুষ্ঠু ও নিরাপদ অভিবাসন পদ্ধতি গ্রহণ এবং বাস্তবায়নসহ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কাজকর্ম মনিটর করা। ৩. দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। ৪. আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে জনগণের সহযোগিতাকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে প্রতিটি উপজেলায় এসংক্রান্ত কমিটি গঠন করা যেতে পারে। ৫. এসংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি এবং দোষীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ৬. বাংলাদেশ থেকে বহির্বিশ্বে যেসব রুটে বৈধ আন্তর্জাতিক অভিবাসন ঘটে, সেসব স্থান চিহ্নিত করে তা বন্ধের ব্যবস্থা নিতে হবে। ভ্রমণ ভিসায় বিদেশ যাওয়ার আড়ালে আমাদের বিমান বা স্থলবন্দরগুলো থেকে ওই সব ব্যক্তি যাতে বহির্গমন করতে না পারে সে জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ৭. এসব অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এ বিষয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহযোগিতার চিন্তা করা যেতে পারে। প্রয়োজনে জাতিসংঘের সাহায্য ও সহযোগিতা নেওয়া যায়।</p> <p>সর্বোপরি অবৈধ অভিবাসনের এ ভয়াবহ পরিণতি থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে আমাদের কেউ যেন ওই দুষ্টচক্রের খপ্পরে পা না দেয়; বরং বৈধভাবে বিদেশে কাজ নিয়ে যাওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে সে বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকাজুড়ে এসব জঘন্য কাজে নিয়োজিত দালালচক্র ও তাদের মূল হোতাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সোপর্দ করতে হবে।</p> <p>লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব</p> <p> </p>