<p>বিশ্বের অনেক দেশই এখন স্মার্ট সিটির দিকে ধাবিত হচ্ছে। বাংলাদেশেও হাতে নেওয়া হয়েছে প্রযুক্তিনির্ভর এই সিটির প্রকল্প। এই স্মার্ট সিটির প্রথম ও প্রধান শর্ত হচ্ছে, সেখানকার বাসিন্দাদের আবশ্যিকভাবেই স্মার্ট হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আর সে জন্য প্রথমেই গুরুত্ব দিতে হবে আমাদের শিক্ষায়। পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ে আসতে হবে স্মার্ট প্রযুক্তির আওতায়। প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল শিক্ষা ছাড়াও স্মার্ট সিটি গঠন করা যাবে, তবে সেটা টেকসই হবে না। কারণ ডিজিটাল শিক্ষার বাইরে থাকা মানুষ কোনো না কোনো সময় স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে বা সেটি ব্যবহারে দক্ষ হয়ে উঠবে না কখনো।</p> <p>আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা খুব একটা খারাপ অবস্থায় না থাকলেও এটা দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের উপযোগী। তৃতীয় ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী হয়ে এটা এখনো গড়ে ওঠেনি। যদি চতুর্দশ শতকের জার্মান ক্লাসরুমগুলো দেখি তাহলে দেখব, একজন শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছেন, শিক্ষার্থীরা তাঁর সামনে বসে লেকচার শুনছে এবং পরে তা মুখস্থ করছে। আমাদের আজকের ক্লাসরুমগুলোরও একই অবস্থা। এর থেকে আমরা এখনো বেরোতে পারিনি। প্রযুক্তিগত কিছু সংযোজন হলেও শিক্ষাদান পদ্ধতিতে খুব একটা পরিবর্তন এখনো আসেনি। আমাদের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ এই শিক্ষাব্যবস্থাকেই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য তৈরি করা। কিভাবে সেটি করা যাবে, তা-ই নতুন করে ভাবতে হবে আমাদের। গভীর মনোযোগ দিতে হবে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে স্মার্ট শিক্ষায় রূপান্তরে।</p> <p>১৯৮৯ সালে ইউনেসকো একটি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় চারটি উদ্দেশ্যের কথা বলেছে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো জানার জন্য শিক্ষা বা শিখন, দ্বিতীয়টি হলো কাজের জন্য শিক্ষা বা শিখন, তৃতীয়টি হচ্ছে মিলেমিশে বসবাস করার জন্য শিক্ষা বা শিখন এবং চতুর্থটি হচ্ছে উত্কর্ষ সাধন, বিকাশ ও অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীলতা অর্জনের জন্য শিক্ষা বা শিখন।</p> <p>বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় ইউনেসকোর প্রথম দুটি উদ্দেশ্য থাকলেও মিলেমিশে বসবাস বা অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীলতা অর্জনের জন্য যে শিক্ষা বা শিখন তা অনেকটাই অনুপস্থিত। প্রকৃত নাগরিক গড়তে, মানবিক স্মার্ট মানুষ গড়তে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সেই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার দিকে জোর দিতে হবে। অথচ সেটিই এখনো পারছি না আমরা।</p> <p>বিশ্বব্যাপী শিক্ষাব্যবস্থায় ইনস্ট্রাকটিজম, কনস্ট্রাকটিজম ও কানেকটিভিজম—এই তিন ধরনের ক্লাসরুম শিক্ষাদান পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। আমাদের কনস্ট্রাকটিজমে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এটাকে আমরা বলছি প্রজেক্ট, প্রবলেম ও এক্সপিরিয়েন্স বেইসড লার্নিং।</p> <p>আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে বর্তমান পৃথিবীতে যে জ্ঞান আছে, সেই জ্ঞানকে প্রযুক্তির মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে নতুন করে উৎপাদনের চেষ্টা করতে পারি। এই পদ্ধতির মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী সমাজে চলার নিয়ম, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি এবং অন্যের কাছে তা স্থানান্তর করতে শিখবে। এই পদ্ধতিকেই আমরা বলছি জ্ঞানের পুনরুৎপাদন বা কনস্ট্রাকটিজম। এখানে শিক্ষার্থীরা কাজ করতে করতে শেখে। শিক্ষক এখানে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করেন।</p> <p>আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে জ্ঞানের স্থানান্তর। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার জন্য জ্ঞানের স্থানান্তর অত্যাবশ্যক, তবে জ্ঞানের পুনরুৎপাদন করতে পারলে শিখন অনেক সহজ হয়ে যায়। অনেক দেশই এরই মধ্যে এই পদ্ধতিগুলোকে শ্রেণিকক্ষে নিয়ে আসতে সক্ষম হলেও আমরা এখনো এর থেকে দূরে আছি। ইনস্ট্রাকটিজম পদ্ধতিতে শিক্ষক ক্লাসে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে লেকচার প্রদান করেন; এখানে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের কাছ থেকে সরাসরি শেখে।</p> <p>আর কানেকটিভিজম হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ বা প্রদান। এই নেটওয়ার্কটা ফিজিক্যাল নেটওয়ার্ক হতে পারে, আবার ভার্চুয়াল নেটওয়ার্কও হতে পারে।</p> <p>আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ইনস্ট্রাকটিজমনির্ভর। অর্থাৎ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি। আমরা সবাই এই পদ্ধতির মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছি। এখানে কোলাবরেশন, পার্সোনালাইজ লার্নিং ও ডিফারেনশিয়েটেড লার্নিংয়ের সুযোগ নেই। এটা অনেক পুরনো পদ্ধতি। এই পদ্ধতি দিয়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য দক্ষ জনবল তৈরি করা সম্ভব হবে না। তাই আমাদের পরীক্ষিত কোনো বিকল্প পদ্ধতির দিকে যেতে হবে। আর সেই পদ্ধতি হতে পারে স্মার্ট শিক্ষা। তার জন্য প্রয়োজন হবে স্মার্ট ক্লাসরুম।</p> <p>এখন মৌলিক শিক্ষাকে যদি স্মার্ট করতে হয় তাহলে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, কলা ও গণিতের শিক্ষাটাই প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেওয়া যেতে পারে। সেটা রোবট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) কিংবা প্রগ্রামিংয়ের মাধ্যমে হতে পারে।</p> <p>এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৩০ জন শিক্ষার্থীকে যদি একজন শিক্ষকের মাধ্যমে একটি ক্লাসরুমে শিক্ষা প্রদান করা হয় তাহলে তার শিক্ষার মান এক রকম। তাকে যদি মাস্টারিং পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদান করা হয় তাহলে সে একটু বেশি শিখেছে। তারপর ওয়ান টু ওয়ান বা টিউটরিং পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদান করা হলে সেখানে ফল আরো ভালো হয়। আমাদের ক্লাসরুমগুলো স্মার্ট করতে হলে প্রযুক্তির মাধ্যমে করতে হবে। তাহলে আমরা ওয়ান টু ওয়ান, মাস্টারিং ও টিউটরিয়াল লার্নিং টেকনোলজির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে পারব।</p> <p>আমাদের শিক্ষার্থীদের টেকনোলজির মাধ্যমে ডিফারেনশিয়েটেড লার্নিং দেওয়া হলে ফল অনেক ভালো হবে। শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা বাড়বে এবং তারা শিখতে ভালোবাসবে। ব্লন্ডেড লার্নিংয়ের মাধ্যমে এটা প্রদান করা যেতে পারে। এখানে ফেস টু ফেসও থাকবে আবার অনলাইনও থাকবে। এই ব্লন্ডেড লার্নিং দিতে হবে ফ্লিপড ক্লাসরুমের মাধ্যমে, যেখানে ভিডিও লেকচার বা শিক্ষক যা পড়াতে চান, শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসার আগেই কোর্স শিক্ষক তাদের দিয়ে দেবেন। শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুমে আসার আগে এগুলো দেখে আসবে। ক্লাসরুমে এসে সমস্যা সমাধান, কোলাবরেশন ও এনগেজমেন্ট করবে। তারপর বাসায় গিয়ে সেই রিফ্লেকশন করবে সে আসলে কতটুকু শিখল। আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিতে আমরা এখনো এই ব্যবস্থাগুলো নিয়ে আসতে পারিনি।</p> <p>বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে স্মার্ট শিক্ষায় পরিণত করতে নিচের প্রস্তাবটি কাজে লাগানো যেতে পারে :</p> <p>স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থা হবে সম্পূর্ণ ক্লাউডনির্ভর। এখানে কোনো ধরনের হার্ডওয়্যারের প্রয়োজন হবে না। এই শিক্ষাব্যবস্থাকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যেতে পারে—প্রথমত স্কুল ইন ক্লাউড, দ্বিতীয়ত কমিউনিটি স্কুল ইন ক্লাউড এবং তৃতীয়ত রিজিওনাল স্কুল ইন ক্লাউড। এগুলোর প্রতিটি একেকটি লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এই লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমটিকে ট্রেনিং টুল হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে। এখানে ট্রেনিংয়ের বিষয়গুলো থাকবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এখান থেকে শিখতে পারবে।</p> <p>আমরা যদি লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে স্কুল ইন ক্লাউড, কমিউনিটি স্কুল ইন ক্লাউড এবং রিজিওনাল স্কুল ইন ক্লাউডে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিতে পারি তাহলে দেশের সব শিক্ষাব্যবস্থা স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থার আওতায় চলে আসবে। আবার আমাদের শিক্ষার্থীরা যেকোনো দুর্যোগকালে এই ক্লাউড ব্যবহার করে ঘরে বসে ক্লাস করতে পারবে। সম্প্রতি করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) কারণে সারা দেশের সব স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। ফলে কিছুটা সময় শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা বা ক্লাস থেকে দূরে রয়েছে। যদি দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এই পদ্ধতির আওতায় নিয়ে আসা যায় তাহলে এই সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে। আর যদি আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে স্মার্ট করতে চাই অথবা আমাদের সমাজকে স্মার্ট করতে চাই তাহলে শুধু তথ্যের বিচার-বিশ্লেষণ ও জ্ঞান আহরণ এবং দক্ষতা অর্জনের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করলে হবে না। আমরা সমাজে কিভাবে মিলেমিশে বসবাস করব, কিভাবে উত্কর্ষ সাধন ও অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষ তৈরি করব, সেদিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।</p> <p> </p> <p>লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ</p> <p> </p>