<p>সময়ের প্রবহমানতায় সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে লাগে নানা পরিবর্তনের ছোঁয়া। কখনো ঐতিহ্যের অহংকারে, আবার কখনো নতুন চিন্তা ও ভাবের আবাহনে জাতি জেগে ওঠে। গ্রিক, রোম, ইতালি, পারস্য, আরব এমনকি ভারত তথা বাংলা মুল্লুকেও ঐতিহ্যের অন্বেষণ ও নবজীবনের আবাহনে জাতি জেগে উঠেছে। বাঙালিত্বের উদ্ভাসন কালে কালে ঘটলেও, এর সত্যিকারের জাগরণ ঘটে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। এর ফলে ধর্মীয় ও পাকিস্তানি ভাবধারার বিপরীতে গড়ে উঠে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবোধ এবং তা ক্রমে বিকশিত হয়ে নানা আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে জন্ম সৃষ্টি হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। সমকালের অনেকের মতো আনিসুজ্জামানও এর সারথি হয়েছেন এবং বাঙালিত্বের ঝাণ্ডা হাতে রাজপথে নেমেছেন। এ প্রসঙ্গে এক পত্রে লিখেছেন : ‘গৌরব বোধ করি শুধু এই জন্য যে অনেকের সঙ্গে আমিও এই মহান আন্দোলনে (ভাষা আন্দোলনে) যুক্ত ছিলাম।’ তিনি ছাত্রজীবনেই প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। যোগ দেন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগে এবং ১৯৫১ সালের ডিসেম্বর মাসে এ সংগঠনের দপ্তর সম্পাদক নিযুক্ত হন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি জগন্নাথ কলেজের ছাত্র ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীরাও প্রতিবাদে রাজপথে নামেন। পালন করেন বিভিন্ন কর্মসূচি। আনিসুজ্জামান এসব কর্মসূচিতে যোগ দেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রথম পুস্তিকা (‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কি ও কেন’?), যেটি যুবলীগের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়, সেটির রচয়িতা ছিলেন আনিসুজ্জামান।</p> <p>১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নবাবপুর রোডে আয়োজিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় তিনি উপস্থিত ছিলেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি সকালে উপস্থিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সমাবেশে। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল শুরু করলে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পুলিশের ছোড়া টিয়ার শেল তাঁর গায়েও লাগে, যার স্মৃতিচারণা করে পরবর্তীকালে লিখেছেন : ‘এবারে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়া শুরু করল আমাদের দিকে। আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই, দৌড়ে যাই কলাভবনের পুকুরের দিকে। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, কেউ কেউ পুকুরেই ঝাঁপ দেয়; আমি গেঞ্জি ভিজিয়ে নিয়ে চোখে পানি দিই, শুধু শার্ট পরে থাকি, আর অধিকাংশের সঙ্গে ফিরে আসি রণক্ষেত্রে।’ বেলা ৩টার পরে পুলিশের গুলিবর্ষণে হতাহতের ঘটনা ঘটলে পরিবেশ আরো থমথমে হয়ে ওঠে। এ সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ১১ নম্বর ব্যারাকে স্থাপিত কন্ট্রোলরুমের মাইকে প্রচারের জন্য আনিসুজ্জামান বক্তৃতা লিখে দেন এবং নিজেও বক্তৃতা করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর পিতার গাড়িতে করে লক্ষ্মীবাজার থেকে একটি মাইক ভাড়া করে জগন্নাথ কলেজ হোস্টেলে নিয়ে যান। এরপর মাইকে কিছুক্ষণ বক্তৃতা করেন। এদিন ফরিদপুর কারাগার থেকে একটি টেলিগ্রাম আসে তাঁর কাছে, যাতে শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদের অনশন ও একুশের ঘটনার প্রতিবাদ সম্পর্কিত বার্তা ছিল। এ প্রসঙ্গে ‘কাল নিরবধি’তে লিখেছেন : ‘২৩ তারিখে একটা টেলিগ্রাম পেলাম ফরিদপুর জেল থেকে। রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে সেখানে কয়েক দিন ধরে অনশন করছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদ। একুশের হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে অনশনের কারণ হিসেবে তার প্রতিবাদও তাঁরা যুক্ত করেছেন এবং সে সংবাদ জানিয়েছেন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদককে। এই টেলিগ্রামের ভিত্তিতে একটা খবর তৈরি করে আমি আজাদ পত্রিকায় দিয়ে আসি এবং তা যথারীতি মুদ্রিত হয়।’ ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে শহীদ মিনার নির্মাণের সময় আনিসুজ্জামান সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে জনতা শ্রদ্ধা জানাতে পুষ্পস্তবক ও টাকা-পয়সা নিয়ে ভিড় জমায়। আনিসুজ্জামানের মা সৈয়দা খাতুন শহীদ মিনারের পাদদেশে একটি সোনার চেন দেন, চেনটি ছিল তাঁর মৃত বোনের। ২৫ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘটের প্রচারপত্র রচনা করেন এবং তা মুদ্রণের দায়িত্ব পালন করেন। ৭ই মার্চ শান্তিনগরে ডা. মোতালেবের বাসভবনে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের গোপন বৈঠকে তিনি অলি আহাদকে পৌঁছে দিতে যান। বৈঠক চলাকালে পুলিশ নেতাদের প্রায় সবাইকেই গ্রেপ্তার করে, যার জন্য তাঁদের কেউ কেউ আনিসুজ্জামানকে দোষারোপ করেন, তবে তিনি একে ‘অমূলক ও অন্যায় খোঁচা’ বলে নিজের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেন। </p> <p>১৯৫২ সালের পরও আনিসুজ্জামান একুশের চেতনা লালন ও বাস্তবায়নে সক্রিয় ছিলেন। হাসান হাফিজুর রহমানের একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলন (১৯৫৩) প্রকাশের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনের উৎসর্গপত্রের লেখাটুকু (যে অমর দেশবাসীর মধ্য থেকে জন্ম নিয়েছেন/একুশের শহীদেরা/যে অমর দেশবাসীর মধ্যে অটুট হয়ে রয়েছে/একুশের প্রতিজ্ঞা,—/তাঁদের উদ্দেশে) তাঁর নিজের হাতের। ফেব্রুয়ারির শেষে পুলিশ যুবলীগের অফিস সিল করে দিলে তিনি এবং ইমাদুল্লাহ্ মিলে জেলা শাখার নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেন। পরবর্তীকালে ‘বাংলা ভাষায় সংবিধান লিখতে, সরকারি কাজকর্মের জন্য পরিভাষা তৈরি করতে—এককথায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রবর্তন করার বাস্তব পদক্ষেপ নিতে অন্যদের তুলনায় তিনি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন।’ বাঙালির স্বাধিকার-সংগ্রাম এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও আনিসুজ্জামান যুক্ত ছিলেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠান পালনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়গুলোতে তাজউদ্দীন আহমদ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে থেকে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রীয় নানা দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ‘১৯৭১-এ তিনি বাংলাদেশের জন্য বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছেন।’ মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।</p> <p>একজন গবেষক হিসেবে আনিসুজ্জামান বাঙালিত্বের জাগরণ ও আত্মপরিচয় সন্ধানে কাজ করেছেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো—মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৬৪), মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র (১৯৬৯), মুনীর চৌধুরী (১৯৭৫), স্বরূপের সন্ধানে (১৯৭৬), আঠারো শতকের বাংলা চিঠি (১৯৮৩), মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (১৯৮৩), পুরনো বাংলা গদ্য (১৯৮৪), আমার একাত্তর (১৯৯৭), মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর (১৯৯৮), কাল নিরবধি (২০০৩), আত্মপরিচয় ভাষা-আন্দোলন স্বাধীনতা (২০১৫), বিপুলা পৃথিবী (২০১৫); অনুবাদ : আদর্শ স্বামী (১৯৮২), পুরনো পালা (১৯৮৮) প্রভৃতি। এ ছাড়া সম্পাদনা করেছেন অনেক গ্রন্থ। সাহিত্য সাধনা ও কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ লাভ করেছেন দাউদ পুরস্কার (১৯৬৫), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭০), একুশে পদক (১৯৮৪), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার ও বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৮৬), আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৯), আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৩), পদ্মভূষণ (২০০৫) প্রভৃতি। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করেছে। ২০১৯ সালে লাভ করেন সার্ক সাহিত্য পুরস্কার। বাঙালিত্বের অহংকারে দীপ্যমান এই অক্লান্ত কর্মী এখনো দেশ এবং জাতির হিতসাধনে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন।</p> <p>লেখক : গবেষক প্রাবন্ধিক; শিক্ষক</p> <p>পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়</p>