<p>আজ সাধারণ ধর্মঘটে একাধিক প্রশ্নের জবাব চাইবে মানুষ। রুটিরুজির দাবি থেকে শুরু করে এনআরসি—বিবিধ দাবিদাওয়া নিয়ে এই ধর্মঘটের ডাক মূলত শ্রমিক সংগঠনগুলো দিলেও তাতে কৃষক, খেতমজুর, কর্মচারী, মহিলা, ছাত্র, যুব—সব ক্ষেত্রের সংগঠন সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে। শিক্ষায় গৈরিকীকরণ, শিক্ষার লাগামছাড়া খরচ এবং এনআরসি নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য দুই সরকারের কাছেই জবাব চাইতে প্রস্তুত ছাত্রসমাজও।</p> <p>মোদি সরকার প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরপরই বাকি সব ক্ষেত্রের মতোই হামলা চালিয়েছিল শিক্ষাক্ষেত্রের ওপরও। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত আধুনিক ভারতের ইতিহাসের ওপরই ছিল গৈরিকবাহিনীর সবচেয়ে বেশি আক্রোশ। আপাতদৃষ্টিতে মনে করা হয়েছিল, ইতিহাসের পাতা থেকে স্বাধীনতাসংগ্রাম থেকে শুরু করে নেহরু-গান্ধী পরিবারের নাম চিরতরে মুছে ফেলতেই ক্ষিপ্র এবং আগ্রাসী ভূমিকা নিচ্ছে মোদি সরকার। তবে শেষ পর্যন্ত তা রূপ নেয় আগ্রাসী গৈরিকীকরণের। ইতিহাসসহ গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকেই মনুবাদী ধ্যান-ধারণা ও সংস্কৃতির মোড়কে ভরে দিয়ে আদ্যোপান্ত নতুন এক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে চায় কেন্দ্র। আদতে যা প্রহসনেরই নামান্তর। কিন্তু মোদি সরকারের দ্বিতীয় দফার শুরুতে এসে দেখা গেছে, শিক্ষায় বেপরোয়া গৈরিকীকরণের পাশাপাশি বেসরকারীকরণের থাবাও প্রবলভাবে পড়েছে। এক-এক করে দেশীয় সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অথর্ব করে দেওয়া এবং নানা ধরনের কল্পকথা ও কল্পবিজ্ঞানের নির্যাস শিক্ষাব্যবস্থার মূল স্রোতে ঢুকিয়ে দিয়ে ভারতের সেন্টার অব এক্সিলেন্সগুলোকে পঙ্গু করে তোলাই এই সরকারের একমাত্র লক্ষ্য। বিকল্প হিসেবে দেশের ছাত্রসমাজের কাছে রয়েছে প্রথমত গৈরিক শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাপদ্ধতি এবং দ্বিতীয়ত সেটা পেতে হলেও গুনতে হবে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, যা ভারতের বেশির ভাগ গরিব, নিম্নবিত্ত, এমনকি মধ্যবিত্ত ছাত্র-ছাত্রীদের কাছেও কার্যত অসম্ভব। শিক্ষাক্ষেত্রে এই জোড়া আক্রমণের বিরুদ্ধেই ধর্মঘটে শামিল হচ্ছে গোটা দেশের ছাত্রসমাজও।</p> <p>দেশজুড়ে সাধারণ ধর্মঘটের দাবিগুলোর প্রথম দিকেই আছে জীবন-জীবিকা ও কাজের দাবি। এই দাবি মূলত ছাত্র ও যুবসমাজের। সবার হাতে কাজ চাই—এই স্লোগান তুলে শ্রমিক-কৃষক-কর্মচারীসহ সাধারণ মানুষের ব্যাপকতর এই ধর্মঘটে শামিল হয়েছে পড়ুয়ারা। সরকারের নিজস্ব সমীক্ষা রিপোর্টই বলেছে, গত ৪৫ বছরে দেশে বেকার সমস্যা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে। এক দশক আগে বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার সময়ও যা ভারতে দেখা যায়নি। কাজের সুযোগের অভাব তো ছিলই, তার সঙ্গে জিএসটি এবং নোটবন্দি পরবর্তী পরিস্থিতি আরো প্রায় দুই কোটি মানুষ নতুন করে কাজ হারানোর ফলে কাজের বাজারের চিত্র ভয়াবহ হয়ে  গেছে। পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, দেশের সব কয়টি রাজ্যেই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে এবং তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হতাশা। কাজের বাজার বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যে সরাসরি সম্পৃক্ত তা সবাই এককথায় মানবেন। যেখানে পড়াশোনা শেষ করে কাজ মিলবে কি না সে বিষয়টিই ঘোর অন্ধকারে, সেখানে বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে শিক্ষার খরচ। আইআইএমগুলোতে পড়ার খরচ আগেই বেশি ছিল। তা আরো বাড়ানো হয়েছে। দেশের বেশির ভাগ মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী যেখানে উচ্চশিক্ষার জন্য যাবেন বলে স্বপ্ন দেখেন, সেই আইআইটিগুলোসহ সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে পড়ার খরচ গত আট বছরে বেশ কয়েক দফায় বেড়ে গেছে। প্রতিবারই ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ দেখিয়েছেন ছাত্র-ছাত্রীরা। কিন্তু সুরাহা তো মেলেইনি; বরং কোথাও কোথাও জুটেছে পুলিশের লাঠি। আর এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে বেসরকারি ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানেজমেন্টসহ একাধিক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নামকাওয়াস্তে কিছু উচ্চশিক্ষার সুযোগের কথা বলা থাকলেও বাস্তবে কলেজগুলোর মূল লক্ষ্য ক্যাপিটেশন ফি। যে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে উচ্চশিক্ষা সাধারণ ঘরের কোনো পড়ুয়ার কাছে কার্যত অসম্ভব। ফলে সে শিক্ষার স্বপ্নও গোড়াতেই নির্মূল হয়ে যাচ্ছে। অতি সম্প্রতি হোস্টেলের ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমেছেন দিল্লির জওয়াহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। প্রশাসনের অনড় মনোভাবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই তাঁরা হোস্টেল ফি কমানোর দাবিতে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে  গেছেন। শিক্ষার মাত্রাতিক্ত খরচ নিয়ে জেএনইউ ছাড়াও গত ছয়-সাত বছরে বিভিন্ন সময়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।</p> <p>ছাত্র-ছাত্রীদের হার না-মানা মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে এনআরসিবিরোধী আন্দোলনেও। সম্প্রতি দিল্লিতে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে এনআরসিবিরোধী বিক্ষোভ থামানোর নামে মোদি সরকারের পুলিশ ওই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে রীতিমতো তাণ্ডব চালায়। বস্তুত এই দুটি ঘটনার পরেই গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এনআরসিবিরোধী আন্দোলন। হার মানা, পিছু হটা তো দূরের কথা, নাগরিকত্ব ইস্যুতে ছাত্র-ছাত্রীদের এই নাছোড় মনোভাবই কার্যত পথ দেখিয়েছে বড়দেরও। সেই ক্ষোভ বিক্ষোভ হয়ে আছড়ে পড়বে আজ সাধারণ ধর্মঘটে।</p> <p> </p> <p>লেখক : পশ্চিবঙ্গের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক</p>