<p>ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্প, প্রযুক্তিসহ সব ক্ষেত্রে বিশ্বসভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে। গত ১০০ বছরে বিশ্বে অসাধারণ উন্নতি সাধিত হয়েছে; কিন্তু আধুনিক সভ্যতার বিপরীত স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে প্রচলিত নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। ক্রমেই বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়, নষ্ট হচ্ছে মূল্যবোধ, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও শৃঙ্খলা। ছিন্ন হচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক। ফলে অস্থির হয়ে উঠছে সমগ্র সমাজ ব্যবস্থা।</p> <p>মানুষ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে নতুন নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে নিত্যনতুন মারণাস্ত্র তৈরি করছে। আবার এই মানুষই হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে গবেষণায়, প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে মারণব্যাধি থেকে বাঁচার প্রতিষেধক আবিষ্কারে। কী এক অদ্ভুত আচরণ মানবসভ্যতার। মানুষের মানবীয় গুণাবলি, নীতি-নৈতিকতা, মানবিকতা, দয়া-মায়া দিন দিন হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত হয়ে আসছে। সুধীসমাজের ধারকরা এর প্রতিকারে সমাজবিজ্ঞানীদের দ্বারস্থ হচ্ছেন, সমাজবিজ্ঞানীরা অনবরত পরামর্শ দিয়েই যাচ্ছেন। সভা, সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, মানববন্ধনসহ নানা সচেতনতামূলক কর্মসূচিও পালিত হচ্ছে। আলোচকদের কথায় অনেক মূল্যবান পরামর্শ উঠে আসছে। সেগুলো গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিতও হচ্ছে। কোনো পরিবর্তন কি হচ্ছে?</p> <p>পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড যদি নীতি, সততা ও আদর্শবর্জিত হয়, তাহলে মানবিকবোধ হ্রাস পায়। এতে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, উগ্রতা, হিংস্রতা, অনৈতিকতার প্রসার লাভ করে। শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে না পড়িয়ে অতিরিক্ত টাকার লোভে কোচিং বা প্রাইভেট পড়াতে বেশি পছন্দ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার কেন্দ্র। এখানে হওয়ার কথা জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান বিতরণ। আমরা কি তা খুঁজে পাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে? আমরা কি বুঝি কোচিং সেন্টার আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পার্থক্য? নৈতিকতা শিক্ষা দেন শিক্ষকরা। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তাঁদের শ্রদ্ধা করে। সেই শিক্ষকদের অনেকেই নারী নিপীড়নসহ চরম নৈতিকবিবর্জিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। একটি পদের জন্য একজন শিক্ষক অনেকের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ান।</p> <p>এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখভাল করার জন্য যাঁরা আছেন, সেই কর্তাব্যক্তিরা কিছুদিনের জন্য আসেন বিশাল বিপ্লব সাধন করার জন্য। আর যাঁরা বসে আছেন দীর্ঘদিন ধরে, তাঁদের বেড়াজাল থেকে কোনোভাবেই কর্তাব্যক্তিরা বেরোতে পারেন না। ফলে দেখা যায়, সনদ জালিয়াতরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। দুর্নীতির কারণে বরখাস্ত কর্মকর্তাও হয়ে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।</p> <p>লোভী চিকিৎসকরা কমিশনের জন্য রোগীদের অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করাতে বাধ্য করেন। অপ্রয়োজনীয় হলেও অস্ত্রোপচার করেন। ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা ভিজিট দিয়েও দুই মিনিট কথা বলা যায় না। অনেক সময় সব কথা না বলতে পারার কারণে রোগী মানসিক দিক থেকেও স্বস্তি পায় না—একসঙ্গে চার থেকে পাঁচজন রোগী চেম্বারের ভেতরে অবস্থান করার কারণে অনেক সময় রোগীর গোপনীয়তাও রক্ষা হয় না। অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে জীবন বিনাশ করার কাজে লিপ্ত থাকে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অনৈতিক মুনাফা করতে চায়।</p> <p>খবরের কাগজ খুললেই নারী নির্যাতন-নিপীড়ন, হত্যা, কাজের ছেলে-মেয়ে নির্যাতন ও শিশু নির্যাতন-নিপীড়নের খবর খুব বেশি চোখে পড়ে। এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এ ধরনের ঘটনা যখন বারবার ঘটে তখন তার প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া যেমন খুবই জরুরি, তেমনি সবার নৈতিক দায়িত্বও বটে। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে বিকৃত মানসিকতার শিকার হচ্ছে শৈশব, কৈশোর। বাসে বা মেলায় ভিড়ের সুযোগ নিয়ে নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনা এবং এর ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। কিন্তু সব ঘটনা সামনে আসে না। আইন আছে, আছে সচেতনতার প্রচারও। তবু তালিকা বেড়েই চলেছে।</p> <p>যাঁরা সমাজের মান্যজন, তাঁদের নীতি-নৈতিকতা, আচার-আচরণ, প্রভাব ফেলে সাধারণ মানুষের ওপর। সাধারণ মানুষ তাঁদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে। এ ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের, সমাজ সচেতনদের কথাবার্তা, ন্যায়বিচার খুব সতর্কতার সঙ্গে বলতে বা করতে হয়। সমাজনীতি ও পরিবারনীতি, তরুণসমাজের নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ নিয়ে সরকারের তরফ থেকে যদি নীতিকথা উচ্চারিত হয়, তবে তার প্রতিফলন দ্রুত ঘটে। কারণ সরকারের প্রশাসনযন্ত্র এগুলো মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিতে সক্ষম। সরকারের উদ্যোগে সমাজের অভিভাবক শ্রেণিকে নিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবার ও সমাজের নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কিত আলাদা কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা উচিত। পরিবারের অভিভাবকদেরও নিজের সন্তান ও অন্যান্য সদস্যের আচার-আচরণ এবং চলাফেরার প্রতি খেয়াল রাখা জরুরি। সন্তানের মানসিক গঠনের প্রথম পাঠই শুরু হয় পরিবার থেকে। সুষ্ঠু পারিবারিক বলয় থাকলে সন্তানও সুষ্ঠুভাবে গড়ে ওঠে। বলার অপেক্ষা রাখে না, অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক ঘটনা ও দুর্ঘটনা কখনো কখনো ঠেকানো হয়তো সম্ভব নয়, তবে প্রশ্রয় না দিয়ে সবার স্বার্থে, সমাজের অবক্ষয় রোধের লক্ষ্যে দলীয় বিবেচনা, স্বজনপ্রীতি না করে এসব ঠেকানোর মতো উদ্বুদ্ধকরণমূলক ব্যবস্থা নেওয়া গেলে তা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। মনে রাখা দরকার, এ ধরনের ঘটনা যে কারো পরিবারে হতে পারে।</p> <p>শিশু নির্যাতন-নিপীড়ন ও নারীর প্রতি অশালীন আচরণের ক্ষেত্রে দণ্ডবিধিতে বিভিন্ন ধারায় শাস্তির কথা বলা আছে। বিভিন্ন কারণে তার যথাযথ বা সঠিক প্রয়োগ না হওয়ায় আইনের প্রতি শ্রদ্ধা কম। ফলে শিশু নির্যাতন-নিপীড়ন ও নারীর প্রতি অশালীন আচরণের প্রচার এবং প্রসার ব্যাপক।</p> <p>ওজনে কম দিলে বা ভাড়া বেশি নিলে আমরা উত্তেজিত হয়ে যাই। কিন্তু আমরা আমাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে কতটুকু নীতিবান। আমরা কি আমাদের কাজ বা নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলি? আধুনিকতার সংস্পর্শে আমরা আমাদের কী প্রয়োজন আর কী চাই, তা বুঝতে অক্ষম। তথ্য-প্রযুক্তির কারণে হোক, স্মার্টফোনের কারণে হোক বা ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার কারণে হোক—সামাজিক অস্থিরতায় আমরা আমাদের নীতি ও নৈতিকতা বুঝতে অক্ষম। ন্যায়বিচারের প্রয়োগ না হওয়া পর্যন্ত নীতি ও নৈতিকতার অধঃপতন চলতেই থাকবে। ফলে শিশু নির্যাতন ও নারী নিপীড়নের মতো ঘটনার খবর খুব বেশি বেশি ঘটবে আর খবরের পাতার প্রথমেই তা চোখে পড়বে। নির্বিকারভাবে অবহিত হওয়া ছাড়া আর কী-ই বা আছে!</p> <p> </p> <p>লেখক : অধ্যাপক এবং উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা</p> <p>সাদার্ন ইউনিভার্সিটি</p> <p>sarwarjahan@gmail.com</p>