<p>আজ ৯ জুন ২০১৯ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আর্কাইভস বা লেখ্যাগার দিবস পালিত হচ্ছে। সেই সূত্রে বাংলাদেশেও এই দিবসটি পালিত হচ্ছে। আর এ দেশে এ ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভস এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাংলাদেশ আর্কাইভস অ্যান্ড রেকর্ডস ম্যানেজমেন্ট সোসাইটি (বারমস)।</p> <p>শুরুতেই আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবসটি পালনের পটভূমি আলোচনা করা যাক। ২০০৪ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় বিশ্বব্যাপী আর্কিভিস্টদের বা নথিরক্ষকদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বিভিন্ন দেশ থেকে দুই হাজার প্রতিনিধি যোগ দেন। সম্মেলন শেষে তাঁরা একটি সিদ্ধান্ত নেন যে তাঁরা জাতিপুঞ্জকে (ইউনাইটেড নেশন্স) অনুরোধ করবেন যেন বিশ্বব্যাপী একটি দিবস ‘আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। এরই মধ্যে বেশ কিছু দেশ তাদের দেশে ‘জাতীয় আর্কাইভস’ বা জাতীয় দলিলপত্র দিবস পালন করছে। দিবসটি পালন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের মধ্যে আর্কাইভস বা দলিলপত্র সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং একই সঙ্গে দেশের নীতিনির্ধারকদের আর্কাইভসের গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করানো।</p> <p>২০০৫ সালে ইউনেসকো সাধারণ সভা প্যারিসে তাদের ৩৩তম সভায় ঘোষণা দেয় যে ২৭ অক্টোবর ‘অডিও ভিজ্যুয়াল হেরিটেজ ডে’ বা অডিও ভিজ্যুয়াল ঐতিহ্য দিবস হিসেবে পালন করা হবে।</p> <p>এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সভায়  International Council on Archives-ICA সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা নিজেরাই প্রতিবছর ৯ জুনকে আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবস হিসেবে পালন করবে। তারিখটি চিহ্নিত করার পেছনে একটি ছোট্ট ইতিহাস আছে। ১৯৪৮ সালের ৯ জুন ইউনেসকোর অধীনে International Council on Archives-ICA প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই তারিখ গ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবস পালন বিষয়টি ICA-এর নির্বাহী বোর্ড মেনে নেয় এবং পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী আর্কাইভস সম্প্রদায় গ্রহণ করে।</p> <p>প্রশ্ন হতে পারে, কেন এই আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবস? আমাদের মনে রাখতে হবে দলিলপত্র বা আর্কাইভস হচ্ছে সেসব নথিপত্র, যা সৃষ্টি, সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করা হয় প্রমাণ এবং তথ্য হিসেবে—যা কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির আইনগত বাধ্যবাধকতা বা তার কর্মপরিচালনার কাজে ব্যবহৃত হয়। আর্কাইভস বা লেখ্যাগারে সংরক্ষিত রেকর্ড সেই সব দলিলপত্র বা তার সৃষ্টিকর্তার দ্বারা বা তাদের উত্তরাধিকার বা কোনো উপযুক্ত আর্কাইভস প্রতিষ্ঠান দ্বারা সংরক্ষিত হয়। কেননা তাদের আইনগত মূল্য এবং স্থায়ী ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। আর্কাইভস একটি প্রধান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং তথ্যভাণ্ডার।</p> <p>দিবসটি পালনের মাধ্যমে আমরা সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদি নথিপত্র সংরক্ষণ সম্পর্কে এবং তাদের ব্যবহার করার সুযোগ সবাইকে প্রদান করার ক্ষেত্রেও সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারব। দিবসটিতে প্রদর্শনীর আয়োজন করে বৃহত্তর জনগণকে বিভিন্ন আর্কাইভসে সংরক্ষিত অনুপম, অসাধারণ এবং বিরল নথি জনগণকে দেখাতে পারব। একই সঙ্গে জনগণকে জানানো যাবে যে কি যত্নসহকারে এবং উন্নতভাবে আর্কাইভসে অতি প্রাচীন ও বিরল নথিপত্র সংরক্ষণ করা হচ্ছে।</p> <p>আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়  ‘Designing the Archives in the 21st Century’ অর্থাৎ আমরা কিভাবে একবিংশ শতাব্দীতে আর্কাইভসকে গড়ে তুলতে চাই। উন্নত বিশ্বে বিশেষ করে যেসব দেশের আর্কাইভসের এক বিরাট ঐতিহ্য রয়েছে তারা তো এ ব্যাপারে ব্যাপক পদক্ষেপ নেবে, যেমন—যুক্তরাজ্য জাতীয় আর্কাইভস, যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় আর্কাইভস, কানাডা জাতীয় আর্কাইভস, ফরাসি জাতীয় আর্কাইভস ইত্যাদি। তা ছাড়া ইদানীং যেসব রাষ্ট্রের আর্কাইভস বিশেষ উন্নতি সাধন করেছে যেমন—চীন জাতীয় আর্কাইভস, মালয়েশিয়া জাতীয় আর্কাইভস, সিঙ্গাপুর জাতীয় আর্কাইভস ইত্যাদি তারাও নানা পদক্ষেপ নেবে।</p> <p>এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে কী করা যায় বা কী হবে তা-ই আমাদের বিবেচ্য। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমাদের বাংলাদেশে আর্কাইভস গড়ে তোলার ইতিহাস খুবই সাম্প্রতিক। তবে আশার বিষয় যে সাম্প্রতিক সময়ে আর্কাইভস নিয়ে প্রচুর চিন্তাভাবনা হচ্ছে এবং সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই আর্কাইভস গড়ে তোলা হচ্ছে। আমাদের জাতীয় আর্কাইভস জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ফসল, যা কি না বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভস নামে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। লক্ষ করার বিষয়, ১৯৭২ সালে এ দেশে আর্কাইভস একটি সম্পূর্ণ অপরিচিত শব্দ ছিল। সেখান থেকে আমরা আজ অনেক দূর এগিয়ে গেছি এবং আমাদের জাতীয় আর্কাইভস আজকে দক্ষিণ এশিয়ার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এর পরও আমাদের এখনো অনেক দূর যেতে হবে।</p> <p>আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ মহলেও এখনো আর্কাইভস একটি অপরিচিত প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে এর গুরুত্বের বিষয়টি এখনো তেমনভাবে হৃদয়াঙ্গম করা হয় না। এ কারণে বাংলাদেশে আর্কাইভসের যতটুকু অগ্রসর হওয়া উচিত ছিল ততটুকু হয়নি। আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবস পালন এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করবে বলে আশা করি।</p> <p>বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভসে দেশের ও প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়। সরকারি পর্যায়ে বিপুলসংখ্যক দলিল সৃষ্টি ও সংরক্ষণ করা হয়। এসব দলিল একপর্যায়ে আর্কাইভসে প্রেরণ করা হয়। এ প্রেরণ করার ক্ষেত্রে সরকারি যেমন নীতিমালা রয়েছে, তেমনি রয়েছে জাতীয় আর্কাইভস নির্দেশনা। কিভাবে শ্রেণিবিন্ন্যাস করা হয়, কোনগুলো স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করতে হবে তারও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। বাংলাদেশে সরকারি দলিলপত্রের সবচেয়ে বড় সংগ্রহশালা হচ্ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং তাদের অধীনে দপ্তর, অধিদপ্তর, বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের অফিস-আদালতগুলো। এসব দপ্তরে বিপুল দলিলপত্র রয়েছে এবং বিদ্যমান সচিবালয় নির্দেশমালা অনুযায়ী দলিলপত্র ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর সেগুলো জাতীয় আর্কাইভসে স্থায়ী সংরক্ষণের জন্য প্রেরণ করতে হবে। দুঃখের বিষয়, এ কাজটি সুচারুরূপে পালিত হচ্ছে না। ফলে আমাদের জাতীয় আর্কাইভস যতটুকু সমৃদ্ধ হওয়ার কথা ছিল ততটুকু হয়নি। বেসরকারি খাতে আর্কাইভস এখনো বহু পিছিয়ে আছে।</p> <p>এযাবৎ যেসব আর্কাইভস গড়ে উঠেছে তা সনাতনিভাবেই গড়ে উঠেছে। আর এগুলো সবই হচ্ছে কাগজে লেখা নথি দলিলপত্র। আমরা একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে আর্কাইভস গড়ে তুলতে চাই একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে। এর বহুল প্রচারও দরকার। সনাতনি প্রথায় যেভাবে আর্কাইভস গড়ে উঠেছে তাকে আরো সাবলীল করে তোলা এবং নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা।</p> <p>আমাদের আর্কাইভসগুলোকেও ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে আধুনিক করে গড়ে তুলতে হবে। সুখের বিষয়, এই ডিজিটাল পদ্ধতিতে দলিলপত্র ও নথি সংরক্ষণ করা এবং সেবা প্রদান করা এরই মধ্যে বাংলাদেশে শুরু হয়ে গেছে। একই সঙ্গে পুরনো যেসব দলিল ও নথি রয়েছে সেগুলোও ডিজিটাইজড করা হচ্ছে। বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভস এ কাজ খুব দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিচ্ছে। এ প্রসঙ্গে দেশের সরকারও এগিয়ে আসছে। বাংলাদেশে ডিজিটাল আর্কাইভস এখন সময়ের ব্যাপার।</p> <p> </p> <p>লেখক : ইতিহাস ও দর্শন বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বাংলাদেশ আর্কাইভস অ্যান্ড রেকর্ডস</p> <p>ম্যানেজমেন্ট সোসাইটি (বারমস)</p>