<p>অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতিবছর ২১ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে ‘শান্তির অধিকার, মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার ৭০ বছর।’ শান্তির অধিকারকে মানবাধিকারের একটি অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপনকে আরো অর্থবহ করে তোলার উদ্দেশ্যেই হয়তো এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়টি নির্ধারিত হয়েছে। আসলে মানবাধিকার অর্জনের মাধ্যমেই তো মানুষ শান্তির সুবাতাস প্রত্যাশা করে।</p> <p>১৯৮১ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। বিশ্বের সব দেশ ও মানুষের মধ্যে শান্তির আদর্শ শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যেই ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। যেহেতু সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় মঙ্গলবার জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন শুরু হয়, সে কারণে ওই দিনই দিবসটি পালনের জন্য ঠিক করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো দিবসটি পালিত হয়। ওই দিনটি ছিল সেপ্টেম্বরের ২১ তারিখ। পরে ২০০১ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ সেপ্টেম্বরের তৃতীয় মঙ্গলবারের পরিবর্তে ২১ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২০০২ সাল থেকে ২১ সেপ্টেম্বরে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।</p> <p>সারা বিশ্বেই দিবসটি পালন করা হচ্ছে তিন যুগ ধরে। শান্তির সুবিশাল ছায়াতলে বাস করার জন্য সারা বিশ্বের সাধারণ মানুষের এই যে এত আকুতি আর আবেদন-নিবেদন, আসলে কেউ তাতে কোনো কর্ণপাত করছে বলে মনেই হয় না। তা না হলে দেশে দেশে এত যুদ্ধবিগ্রহ লেগে আছে কেন? বিভিন্ন ধর্ম আর বর্ণের মধ্যে বিদ্বেষ, ক্ষমতার দাম্ভিকতা আর আধিপত্যবাদের দাপট আজও পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়নি। সভ্যতার এত উৎকর্ষের পরও পৃথিবীর মানুষকে গুটিকয়েকের হাতে বন্দি করে রাখা হয়েছে। শান্তির জন্য কাঁদতে কাঁদতে মানুষ আজ সত্যিকার অর্থেই দিশাহীন। যাদের হাতে শান্তিগৃহের চাবি, তারাই তো তা বন্ধ করে রেখেছে। তাদের উচ্চারিত শান্তির বাণী যে তাদের কর্ণকুহরেই পৌঁছাচ্ছে না, তা পৃথিবীর তাবৎ মানুষই অবগত।</p> <p>এই যে বিশ্বে অশান্তি বিরাজ করছে, এসব কারা করছে? নিশ্চয়ই কোনো শান্তিপ্রিয় বা শান্তিতে বিশ্বাসী মানুষ এগুলো করছে না। বিশ্বজুড়ে যারা মোড়লগিরি করছে তারাই তো অশান্তির বীজ বপন করে চলছে। তারা ভালো করেই জানে যে তাদের থামাতে কেউ এগিয়ে আসবে না। যদি কেউ এগিয়ে আসে সে ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই অন্য কোনো অভিসন্ধি রয়েছে। শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে অবশ্যই নয়। সবই স্বার্থ, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তারের স্বার্থ। যদি শান্তিই তাদের কাম্য, তাহলে তো পৃথিবীতে এত সংঘাত আর হানাহানি কবেই দূর হয়ে যেত। বিশ্ব পরিণত হতো শান্তির এক বিস্তীর্ণ উদ্যানে।</p> <p>আজকের বিশ্বে, বিশেষ করে ফিলিস্তিন, সিরিয়া, দক্ষিণ সুদান, ইরাক, লিবিয়া, ইউক্রেন, লেবানন, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশে যে অশান্তির উত্তাল তরঙ্গ ভেঙেচুরে চুরমার করে দিচ্ছে সাধারণ মানুষের শান্তির স্বপ্ন, তা নিশ্চয়ই শান্তির অমোঘ বাণী যাদের কণ্ঠে নিয়ত উচ্চারিত হচ্ছে, সেই দলেরই কারো না কারো কারসাজি। তাহলে সব যুদ্ধবিগ্রহ কে বন্ধ করবে? এমনটি চলতে থাকলে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা কি আদৌ সম্ভব? অশান্তির এত ডামাডোলের মধ্যে বসবাস করে আমরা কি আসলেই শান্তির কথা ভাবতে পারি? কাদের আশ্বাসে আমরা শান্তির স্বপ্ন দেখব? সব কিছুই যেন ধোঁকা।</p> <p>ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি কখনো কোনো ব্যক্তিরই বিদ্বেষ প্রকাশ করা উচিত নয়। সব ধর্মের প্রতি, সব ধর্মের মানুষের প্রতি আমাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা থাকতে হবে। আমাদের কাজকর্মে বা আচরণে পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা ও সহনশীলতা দেখাতে হবে। একজন মানুষের কাছে আরেকজন মানুষ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান—এ সংস্কৃতি শুধু বিশ্বাস করাই নয়, চিন্তা-চেতনায় ধারণ করতে হবে। এর ফলে আমরা শুধু উপকৃতই হব না, শান্তির অজস্র ধারায় নিজেদের সিক্ত করতে পারব।</p> <p>শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের তাকাতে হবে দরিদ্র দেশগুলোর দিকে, সে দেশগুলোর হতদরিদ্র জনগণের দিকে। বিশ্বে শান্তির আবহ সৃষ্টি করতে হলে দারিদ্র্যের ভয়াবহ অবস্থা থেকে তাদের উদ্ধার করতে হবে, বাঁচাতে হবে। দরিদ্র মানুষকে অভুক্ত রেখে পৃথিবীতে কোনো দিন শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, মানবাধিকার নিশ্চিত করা যাবে না। এটিই চরম সত্য। আমরা অস্ত্র তৈরি করছি, অস্ত্রের ব্যবসা করে অর্থ কামাচ্ছি। ওই অস্ত্র ব্যবহার করা হয় মানুষ মারার জন্য। অস্ত্র না বানিয়ে সেই অর্থে সারা বিশ্বের দরিদ্র মানুষের আহার, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদির সংস্থান করা যায়। শান্তির স্লোগান তো এমন হতে পারত, ‘অস্ত্র উৎপাদন বন্ধ করো বা সকল অস্ত্র ধ্বংস করো।’ সবেধন নীলমণি যে জাতিসংঘ, তারও ক্ষমতা নেই এমন উদ্যোগ নেওয়ার। পারতপক্ষে অস্ত্র উৎপাদন সীমিত করার চিন্তাভাবনাও তো করা যেত। তাহলে এসব কাগুজে শান্তি দিবস পালন করে কি কোনো লাভ আছে?</p> <p>বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ এখনো সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। খাদ্য আর আশ্রয়ের খোঁজেই যখন তারা দিশাহারা তখন শান্তি নামের স্বপ্নটির কথা তারা চিন্তাও করতে পারে না। অথচ তারাও এ বিশ্বেরই একজন বাসিন্দা; হোক সে সাদা বা কালো, মুসলমান বা খ্রিস্টান, উন্নত বা অনুন্নত কোনো এক দেশের। বিশ্ব সমাজ ব্যবস্থায় এই অবহেলিত মানুষের কি ঠাঁই হবে না? তাদের জন্য বিশ্ববিবেক কি আতঙ্কিত হয়ে ওঠে না? তাদের বাদ দিয়ে কী করে যে বিশ্বে শান্তি স্থাপিত হবে, বুঝি না। যতটুকু মনে হয়, তাদের ছাড়া সমাজ পরিপূর্ণ হতে পারে না। তাদের অন্যদের মতোই কাঙ্ক্ষিত নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। আমার বিশ্বাস, একটি সাম্যতার সামাজিক আবহ সৃষ্টির মাধ্যমেই পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ অনেকটা সুগম হতে পারে।</p> <p>মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকে গুরুত্ব দিয়ে এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় মানবাধিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এ কথা সত্য যে মানবাধিকার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে শান্তি স্থাপনের কাজটি অনেক সহজ ও সুগম হতে পারে। আর সে কারণেই এবার আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস পালনে মানবাধিকারের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বর্তমানের এই হ-য-ব-র-ল অবস্থার বিশ্বে হয়তো শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা করা যায়, এমনকি উদ্যোগও নেওয়া যায়; কিন্তু বাস্তবে যে তা কোনো দিন ঘটানো যাবে, সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। তা না হলে বাংলাদেশের পাশের দেশ মিয়ানমারে এভাবে রোহিঙ্গা নিধন আর উচ্ছেদের কর্মকাণ্ড ঘটে যেতে পারে? সেখানে শুধু মানবাধিকারই লঙ্ঘিত হয়নি, গণহত্যার মতো বর্বরতার শিকার হয়েছে রোহিঙ্গারা। সেই কর্মকাণ্ডের জন্য পৃথিবীর মানুষ ধিক্কার জানালেও তাতে মিয়ানমারের কিছুই হলো না। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশেই পড়ে রইল। শান্তিতে নোবেল পাওয়া অং সান সু চি শান্তির পায়রা না উড়িয়ে মানবতার বিপক্ষে সোচ্চারিত হলেন, গণহত্যার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করলেন। তাদের সমর্থনও করে যাচ্ছে পৃথিবীর দু-একটি দেশ। এমনই যদি হয় শান্তি প্রতিষ্ঠার আলামত, তবে সেই শান্তি কি আদৌ আমাদের প্রয়োজন আছে?</p> <p>ধর্ম-জাতি-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনের মাধ্যমে শান্তি স্থাপনের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা আর দায়বোধ সঞ্চালন করতে পারলে পৃথিবীটাই হয়ে উঠতে পারে শান্তি ও সমৃদ্ধির সূতিকাগার। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই শান্তির পক্ষের কিছু না কিছু মানুষ রয়েছে। আমার বিশ্বাস, তাদের একত্র করে ঐক্যবদ্ধভাবে যদি শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করা যায়, তাহলে হয়তো ফল পাওয়া যেতে পারে। তবে সেই প্রচেষ্টায় বাধা এলে অতিক্রান্ত করার ক্ষমতা অর্জন বড়ই কঠিন ও দুরূহ।</p> <p>ধনী আর দরিদ্রের মধ্যে আয়বৈষম্য হ্রাস করা গেলে পৃথিবীতে দারিদ্র্যের হার অনেকটাই কমে আসবে। কারণ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া সমাজে শান্তি শান্তি বলে চিৎকার করলেও তা কোনো দিন আসবে না। মানুষের আর্থিক অক্ষমতা তার সুকুমার চেতনাকে জাগ্রত করতে সহায়ক নয়। দারিদ্র্যকে সমাজ থেকে হটাতে পারলে অন্য প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলো সহজেই মেটানো সম্ভব হয়। বিশ্বে শান্তি স্থাপনের জন্য বিষয়টির প্রতি অবশ্যই দৃষ্টি দিতে হবে।</p> <p>আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস পালন করা তখনই অর্থবহ হবে যখন বিশ্ব থেকে দারিদ্র্য, যুদ্ধবিগ্রহ, বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদি চিরতরে বন্ধ করা যাবে। এ জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোকেই। বাংলাদেশের জনগণ শান্তিতে বিশ্বাস করে, সহমর্মিতায় বিশ্বাস করে, সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করে। আমরা বিশ্ববাসীর সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিটি পদক্ষেপ ও প্রচেষ্টায় অংশ নিয়ে দিবসটির মর্যাদাকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই। দিবসটি বাস্তবতার আলোকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হলে হয়তো একদিন সারা বিশ্বে সত্যিকারের শান্তি বিরাজ করবে। দিবসটিকে যেন শুধু পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা না হয় সে প্রচেষ্টাকে সম্মিলিতভাবে আরো জোরালো করতে হবে। আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস পালনের উদ্দেশ্য সফল হোক—সে কামনাই করি।</p> <p><strong>লেখক : </strong>সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব</p>