<p>সামাজিকীকরণ হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে ব্যক্তি জনকল্যাণের নিমিত্তে একত্রে নির্ভরযোগ্য আচরণ করতে শেখে এবং এটি করতে গিয়ে সামাজিক আত্মনিয়ন্ত্রণ, দায়িত্বশীল ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অভিজ্ঞতা লাভ করে। সামাজিকীকরণের প্রধান ক্ষেত্র পরিবার। পারিবারিক শিক্ষা, আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি শিশুর পরবর্তী জীবনে খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করে। এ নিয়ে প্রচুর গবেষণাও হয়েছে। বর্তমান সময়ে গবেষণার একটি প্রধান বিষয় পারিবারিক কলহ।</p> <p>বর্তমান যান্ত্রিক জীবনে পারিবারিক কলহ কিভাবে মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করছে আর সেখান থেকে কিভাবে অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো যায় এ বিষয়গুলো আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যৌথ পরিবার ধারণা থেকে সরে এসে মানুষ একক পরিবারের ধারণাকে গ্রহণ করেছে। এতে দোষের কিছু নেই। অন্যদিকে যৌথ পরিবার বা একক পরিবার কোনটি বেশি ফলপ্রসূ এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন তর্কবিতর্ক থাকতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যে প্রকৃতির পরিবারই হোক না কেন, সেই পরিবারের সম্প্রীতির বিষয়টি নিয়ে সবার আগে ভাবতে হবে। একক পরিবারের প্রধান দুটি অঙ্গ মা ও বাবা। তাঁদের পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সম্পর্কের ওপর অনেকাংশে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল। ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চ কাউন্সিল দ্বারা পরিচালিত সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণায় বলা হচ্ছে, পারিবারিক কলহের কারণে কেন সন্তানরা মানসিক ও আচরণগত দিক থেকে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ধরনের পরিবারের সন্তানরা তাদের মা-বাবাদের কলহের জন্য নিজেকে দোষী ভাবতে শুরু করে। এর ফলে তাদের আচরণগত বৈশিষ্ট্য বিরূপভাবে প্রভাবিত হয়, যা তাদের মধ্যে সমাজবিরোধী আচরণ গড়ে তোলে। যদি তাদের মা-বাবার বাদানুবাদ একটি সন্তানের আবেগ ও অনুভূতিকে প্রভাবিত করে বা মা-বাবার বিচ্ছেদ ঘটার আশঙ্কা থাকে, তবে সন্তানদের মানসিক সমস্যায় ভুগতে হতে পারে, যেমন—বিষণ্নতা ও উদ্বিগ্ন থাকা।</p> <p>বর্তমান সময়ের গবেষণায় পারিবারিক কলহের কারণ হিসেবে অনেকেই দুটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন। এর একটি হলো কাজের কারণে পরিবারের সঙ্গে বিবাদ, এটাকে মনস্তত্ত্বের ভাষায় ওয়ার্ক হলিজম বলা হয়। আর অন্যটি হলো পরিবারের কারণে কাজের ক্ষেত্রে ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়া। পরিবারের কারণে কাজের ক্ষেত্রে মানসিক চাপ সৃষ্টি অনেক কারণে হতে পারে। যেমন—মা ও বাবার সন্তানকে যে সময়টুকু দেওয়া দরকার তা না দেওয়া, সন্তানের যত্ন, গড়ে ওঠা ও শিক্ষার ক্ষেত্রে মা-বাবার যে সামাজিক ও মানসিক দায়বদ্ধতা তা যথাযথভাবে পালন না করা, পরিবারের মা-বাবা বা অন্যদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, পরিবারের উচ্চবিলাসী আকাঙ্ক্ষা, বৃদ্ধ মা-বাবার দায়িত্বের ক্ষেত্রে অবহেলা, মা-বাবার মধ্যে প্রফেশনাল জেলাসি ইত্যাদি।</p> <p>কানাডিয়ান রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর ল অ্যান্ড দ্য ফ্যামিলি তাদের সাম্প্রতিক গবেষণায় বলছে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ফলাফলের কারণে পারিবারিক কলহ ঘটতে পারে। যেমন—কোনো একটি রাষ্ট্রের কৃষি বা শিল্পের ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা কমে গিয়ে অর্থনীতির ওপর চাপ পড়ে কিংবা বেকারত্ব বৃদ্ধি, সন্ত্রাস ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে সামাজিক অস্থিরতা দেখা যায়। এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পরিবারগুলোর ওপর বিরূপভাবে পড়তে পারে। জার্নাল অব ফ্যামিলি সাইকোলজিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় পারিবারিক কলহের সঙ্গে জিনগত ও পরিবেশগত প্রভাবের এক ধরনের সম্পর্ক রয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছে। জিনগত কারণে ৩৬ শতাংশ পারিবারিক কলহের সৃষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে পারিবারিক, ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিবেশগত কারণে ৬৪ শতাংশ পারিবারিক কলহ দেখা যায়। যেমন—গ্রাম ও শহরের জনগোষ্ঠীর পারিবারিক কলহের প্রকৃতি ও সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন হয়। একইভাবে উন্নত ও অনুন্নত রাষ্ট্রের পারিবারিক কলহের কারণ ও ফলাফলও বিভিন্ন ধরনের হয়। এখানে চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিস্ময় রোসেতো রহস্যের বিষয়টি উদাহরণ হিসেবে আনা যেতে পারে। রোম থেকে আনুমানিক ১০০ মাইল দূরে ইতালির ফগিয়া প্রদেশের একটি গ্রাম রোসেতো ভালফোর্তোর।</p> <p>কেন রোসেতো ভালফোর্তোর মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয় না, এ বিষয়টি গবেষণা করে বের করার সিদ্ধান্ত নিলেন ইউনিভার্সিটি অব ওকলাহোমার শিক্ষক ও বিশিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানী স্টুয়ার্ট ওলফ। এ কাজে তাঁর সঙ্গী হিসেবে নিলেন সমাজবিজ্ঞানী জন বরোন এবং সমাজবিজ্ঞান ও মেডিক্যাল গ্র্যাজুয়েট ছাত্র-ছাত্রীদের। তাঁরা রোসেতোর ঘরে ঘরে গিয়ে সেখানকার অধিবাসীদের সাক্ষাৎকার নেন। গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ওলফ ও তাঁর দল এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে রোসেতোর মানুষের হৃদরোগ না হওয়ার রহস্যের মূল কারণ খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, জিন, সামাজিক উন্নয়ন, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কোনো প্রভাব নেই। বরং পারিবারিক ও সামাজিক সম্প্রীতি ও বন্ধন তাদের হৃদরোগ না হওয়ার প্রধান কারণ। এখন পর্যন্ত মেডিক্যাল সায়েন্সে রোসেতো ইফেক্ট হিসেবে স্বীকৃত আছে যে দৃঢ় পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানও এভাবে পারিবারিক বন্ধনকে স্বীকৃতি দিয়েছে।</p> <p>বর্তমানে আমাদের দেশে পারিবারিক কলহের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। আমরা উন্নত রাষ্ট্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছি, আবহমান পারিবারিক বন্ধন ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আসছে। কাজেই রাষ্ট্রের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক বন্ধনের কিভাবে উন্নয়ন ঘটানো যায় সে বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। কারণ পারিবারিক সম্পর্কের উন্নয়নই হলো মানবিক উন্নয়ন ও মানবিক আচরণের একটি প্রধান উপাদান। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন মনে করেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানবিক উন্নয়ন একে অন্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। এ জন্য উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে মানবিক প্রগতির বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। এখানে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের চেয়ে মানবিক প্রগতি রাষ্ট্রের সমৃদ্ধিতে অনেক বেশি অবদান রাখতে পারে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে পারিবারিক বন্ধনের উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও পারিবারিক কলহ নিয়ে আমাদের দেশে তেমন কোনো গবেষণা নেই। পারিবারিক কলহে হত্যা ও নিষ্ঠুরতার প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে নারী ও শিশুরা। বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ড ও নির্মমতা ঘটছে যৌতুক, পরকীয়া, দাম্পত্য সমস্যা ও জমিজমা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে। অপরাধ বিশ্লেষক ও মনোবিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, নৈতিক শিক্ষা, সহনশীলতার অভাব এবং মূল্যবোধের অভাবে পারিবারিক বন্ধন ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে আত্মকেন্দ্রিক মনোভাবের কারণে অবিশ্বাস, হতাশা, লোভ ও মানসিক বিষণ্নতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রযুক্তির কারণেও পারিবারিক কলহের সৃষ্টি হচ্ছে। যেমন—মোবাইল ফোন, ফেসবুক ও টুইটার নিয়ে মানুষ খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ায় পরিবারের সদস্যরা একে অন্যকে যে পরিমাণ সময় দেওয়া উচিত তা দিতে পারছে না। ফলে পারিবারিক বন্ধন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে। পারিবারিক সম্প্রীতি বজায় রেখে যাঁরা পারিবারিক জীবনকে সফল বলে প্রমাণ করেছেন, তাঁদের জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত করা যায়। এর মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করা সম্ভব। পারিবারিক বন্ধনের ওপর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার জন্য জাতীয় পরিবার গবেষণা ইনস্টিটিউট গঠন করা যেতে পারে। পারিবারিক বন্ধনের সুফলটা তুলে ধরে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারণা চালানো দরকার। পারিবারিক সম্প্রীতির বিষয়টির বিভিন্ন ইতিবাচক দিক তুলে ধরে আমাদের পাঠ্যক্রমগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এতে পরিবারের প্রয়োজনীয়তা ও মূল্য সম্পর্কে শৈশব থেকেই একজন শিশু শিক্ষার্থীর মনোভাব ইতিবাচকভাবে কাজ করবে। এ ধরনের পারিবারিক শক্ত বন্ধনের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকেন্দ্রিক জীবনাচরণকে উদাহরণ হিসেবে আনা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুর মা-বাবার সঙ্গে বন্ধন, বঙ্গমাতার সঙ্গে বন্ধন, পরিবারের সব সদস্যের সঙ্গে বন্ধনের বিষয় এবং এসংক্রান্ত পরিবারিক ঘনিষ্ঠ ফটোগ্রাফগুলো পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে মা-বাবা, সন্তান-সন্ততি ও তাঁর সহধর্মিণীর কথা তুলে ধরেছেন। তাঁর এই পারিবারিক বন্ধন রাজনৈতিক জীবনে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে বলে উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়গুলো সাধারণ মানুষকে জানাতে পারলে তাদের মনোভাব ইতিবাচকভাবে বদলানো সম্ভব। এখন দরকার সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের উন্নয়ন ও দৃঢ় বন্ধন সৃষ্টি করা। এটি যদি করা যায় তাহলে দেশ বাঁচবে, আগামী প্রজন্ম বাঁচবে।</p> <p><strong>লেখক :</strong> অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর</p> <p>asadzmn2014@yahoo.com</p>