<p>অবশেষে সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে জেরুজালেমকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থাপিত হলো। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একের পর এক যে চমক দেখিয়ে চলছেন, নিঃসন্দেহে তাঁর এ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এটা সর্বশ্রেষ্ঠ। অনেক মহল থেকে বলা হচ্ছিল ট্রাম্প প্রথমে ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা চালিয়ে যাওয়ার তাগিদে এ ধরনের সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন থেকে দূরে থাকবেন। কিন্তু না, তিনি বিশ্বব্যাপী সমালোচনার তোয়াক্কা না করে তাঁর সিদ্ধান্তেই অটল থাকলেন। প্রথমে বলা হয়েছিল বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে তিনি নিজে ইসরায়েল সফর করে নতুন দূতাবাসের উদ্বোধন করবেন। কিন্তু পরে তিনি ভিডিও বার্তায় নিজের উপস্থিতি জানান দিলেন এবং তাঁর সিনিয়র উপদেষ্টা নিজ কন্যা এবং জামাতাসহ উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল সেখানে প্রেরণ করলেন। যুক্তরাষ্ট্রের এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক বক্তব্য অব্যাহত রয়েছে এবং বলার অপেক্ষা রাখে না যে এর বিপক্ষে অবস্থানকারীদের সংখ্যাই বেশি। এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ধারণা করেন যে এত দিন ধরে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা (যার মূলে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের অবসান) নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে তথাকথিত নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় আসীন ছিল, এবার সে নিজেই তার নিজের মুখোশ টেনে ছিঁড়ে আসল রূপটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিল যে পুরো বিষয়টাই আসলে ছিল মেকি। আর এ কারণেই সম্ভবত ইসরায়েলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড ফ্রেডম্যান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ভবিষ্যতে ওই অঞ্চলে বৃহত্তর স্থিতিশীলতা আনয়নে সহায়ক হবে। অর্থাৎ তিনি হয়তো কৌশলে এটাই বলতে চেয়েছেন যে সমগ্র বিশ্ববাসী এত দিন যুক্তরাষ্ট্রের যে নাটক দেখেছে এবার সে তার আসল চেহারার আদলে এই অঞ্চলে শান্তি আনয়নে ভূমিকা রাখতে চায়।</p> <p>যুক্তরাষ্ট্র তেল আবিবের পরিবর্তে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস উদ্বোধনে এমন একটি দিনকে বেছে নিয়েছে, যে দিনে আজ থেকে ৭০ বছর আগে তারা ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয় এবং একই সঙ্গে ফিলিস্তিনিরা এই দিনটিকে ৭০ বছর ধরে পালন করে আসছে ইসরায়েলের দখলদারিত্বে তাদের উদ্বাস্তু হওয়ার দিন হিসেবে। এত বড় প্রহসন করে  যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে কিভাবে তাদের নীতি সামলাবে সেটা দেখার বিষয়। ঘরের শত্রু বিভীষণের মতো সৌদি আরবের বর্তমান যুবরাজের অতিমাত্রায় মার্কিনপ্রীতি যুক্তরাষ্ট্রকে অনেকটা প্রীত করেছে। যদি এটাই সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে যে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে মানুষের মনে যে ধারণা রয়েছে, সেটাকে মেনে নিয়েই সে বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে মনোযোগী হবে, তাহলে বলতে হবে যে এটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের একটি কাজ এবং তা মোকাবেলা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ওই অঞ্চলে আরো কিছু নিজস্ব সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে সংগ্রাম করতে হবে, যেমন ইরানের উত্থান, সিরিয়া নিয়ে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার পরস্পরবিরোধী অবস্থান, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ছয় জাতির চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে যাওয়া এবং সৌদি আরবের সঙ্গে ইরান ইস্যুতে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক বোঝাপড়া। উল্লিখিত প্রতিটি ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাব যে এগুলো কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট ঘটনা নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের তরফ থেকে একতরফাভাবে সৃষ্ট, অর্থাৎ বলতে গেলে ইচ্ছাকৃতভাবেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখা, যা যুক্তরাষ্ট্রের অতীতের অনেক নীতি বিশেষ করে জর্জ ডাব্লিউ বুশের নীতির সঙ্গে মিলে যায়। ট্রাম্পের এমন সব নীতি কেনই বা বুশের আক্রমণাত্মক নীতির অনুরূপ, সেটা নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অনেক বিষয় বিবেচনা করতে হবে। ট্রাম্পের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে তিনি দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন, যার জন্য দেশটিকে হয়তো তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক রক্ষা করতে গিয়ে নতুন নতুন অনেক সমস্যায় পড়তে হবে। নির্বাচনের আগে তাঁর বহুল উচ্চারিত স্লোগান ছিল ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন।’ আর এই গ্রেটনেসকে অর্জন করতে গিয়ে তিনি যেভাবে অগ্রসর হচ্ছেন তা নিয়ে খোদ তাঁর নিজ দল রিপাবলিকানদের মধ্যেই শঙ্কার ভাঁজ পড়ছে। রেক্স টিলারসনকে পররাষ্ট্রমন্ত্রিত্ব থেকে বরখাস্ত করে তিনি যা প্রমাণ করলেন, তা হচ্ছে তিনি চার বছরের জন্য নির্বাচিত এবং যা খুশি তা-ই করবেন, যদি কারো ভালো না লাগে তবে সে তার নিজের পথ দেখতে পারে। </p> <p>জেরুজালেম এমন একটি স্পর্শকাতর ইস্যু, যা বলতে গেলে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি একই সঙ্গে মুসলমান, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের কাছে পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত বিধায় শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী পক্ষ কখনো এ বিষয় নিয়ে তাদের আনুষ্ঠানিক অভিমত দেয়নি। গত বছরের ৬ ডিসেম্বর হঠাৎ করে দূতাবাস স্থানান্তর সংক্রান্ত ট্রাম্পের ঘোষণা মার্কিন রাজনীতিতে ইহুদি লবির শক্তিশালী অবস্থান ও ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের অপরিহার্যতাকেই প্রমাণ করে। এর আগে ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস তেল আবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিলেও মধ্যপ্রাচ্যে নিজের অবস্থান ও গ্রহণযোগ্যতা বহাল রাখা এবং জাতীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনে কোনো প্রেসিডেন্টই এমন সিদ্ধান্ত কার্যকর না করে বিশেষ ডিক্রিবলে এত দিন ধরে তা স্থগিত করে আসছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে বর্তমান এই সিদ্ধান্তের পক্ষে মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনেক যুক্তি দেখানো হচ্ছে, আর মূল যুক্তি হচ্ছে তারা আইনগতভাবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধ্য। কারণ এটা কংগ্রেসে পাস করা সিদ্ধান্ত। এত দিন ধরে যেহেতু মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনায় উল্লেখযোগ্য অর্জন সম্ভব হয়নি, সে ক্ষেত্রে বাস্তব অবস্থার আলোকে ইসরায়েলকে ক্ষমতায়িত করে তাদের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিন ও অন্যান্য আরব পক্ষগুলোকে প্রয়োজনীয় ছাড় দেওয়ার কর্তৃত্ব দিয়ে দিলে সংকট সমাধানে তা অধিকতর অর্থবহ হতে পারে।</p> <p>তবে বাস্তব পরিস্থিতি বলছে ভিন্ন কথা। মধ্যপ্রাচ্যে এই মুহূর্তে ইরানকে কোণঠাসা করাই যুক্তরাষ্ট্রের আসল লক্ষ্য এবং সেটা করার দরকার তাদের আজন্ম বন্ধুরাষ্ট্র ইসরায়েলের নিরাপত্তা রক্ষার তাগিদে। সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়ায় ইরানি বহরের ওপর ইসরায়েলি হামলা এই যুক্তিকেই আরো শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছে। আবার একইভাবে ইসরায়েল এমন একসময় এই হামলা চালাল, যখন যুক্তরাষ্ট্র মাত্র দুই বছর আগে ইরানের সঙ্গে করা ছয় জাতি চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই চুক্তিকে বাস্তবসম্মত নয় এবং ইরান এই চুক্তি মেনে চলছে না বলে অভিযোগ করলেও তার ইউরোপীয় তিন মিত্রসহ রাশিয়া ও চীন এমন অভিযোগকে নাকচ করে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা করেছে। এ অবস্থায় সার্বিকভাবে হুমকির মুখে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া-পরবর্তী সময়ে সম্ভাব্য রাশিয়া-ইরান এবং চীন-ইরান দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা ভবিষ্যেক একটি অবশ্যম্ভাবী সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেবে। ইসরায়েল যদি ভেবে থাকে ইরান তার ওপর সিরিয়ায় সংঘটিত হামলার জবাব দেবে না, তাহলেও ভুল ভাবা হবে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এখন এই পরিষ্কার ও আনুষ্ঠানিক অবস্থানের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে অন্ততপক্ষে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা নিয়ে আর কোনো কিছু প্রাপ্তির সুযোগই অবশিষ্ট থাকবে না। এখন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে চীন ও রাশিয়া কী সিদ্ধান্ত নেয় তা দেখার জন্য।</p> <p>(হংকং থেকে)</p> <p><strong>লেখক : </strong>সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়</p> <p>mfulka@yahoo.com</p>