<p>এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের পরও এক শ্রেণির মানুষের প্রভুত্ববাদী মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত সংবিধানের প্রস্তাবনায় লিখিত হয়েছে, ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।’ সংবিধানের প্রথম ভাগে ৭-এর (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’</p> <p>১৯৭২ সালে গৃহীত সংবিধান বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন। আমাদের সংবিধানকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণতান্ত্রিক সংবিধান বলে আখ্যায়িত করা হয়। নিঃসন্দেহে এটি একজন বাঙালি হিসেবে গর্ব করার মতো বিষয়। আমাদের সংবিধানের ছত্রে ছত্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব, সুপ্রিমেসি এবং অধিকার উচ্চকিত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও এ দেশে জনগণের সুপ্রিমেসি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। বরং পাবলিক সার্ভেন্টদের সুপ্রিমেসি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। কিছু মানুষের প্রভুত্ববাদী মানসিকতায় সংবিধানের মূল চেতনা অব্যাহতভাবে লঙ্ঘিত হয়ে চলেছে।</p> <p>সম্প্রতি দেখলাম, একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে স্যার সম্বোধন না করায় তিনি রুষ্ট হয়েছেন। এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া বেশ সরগরম। আমি এই স্বল্পবয়সী সিভিল সার্ভেন্টকে দোষারোপ করব না। তিনি একটি সিস্টেমের উৎপাদন। সিস্টেম তাঁকে এটি শিখিয়েছে। তিনি পাবলিক সার্ভেন্ট হওয়ার জন্য প্রাণপণ লেখাপড়া করেছেন এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে স্বীয় যোগ্যতায় যোগদান করেছেন। যোগদানের পর সিস্টেম তাঁকে পাবলিক সার্ভেন্টের পরিবর্তে ‘লর্ড অব পাবলিক’ বানিয়েছে। যোগদানের আগ মুহূর্তে তিনি দেশ, সংবিধান ও জনস্বার্থের প্রতি চির-আনুগত্যের অঙ্গীকারনামা স্বাক্ষর করেছেন। কিন্তু সিস্টেম তাঁকে জনসেবকের পরিবর্তে জনশাসকে পরিণত করেছে।</p> <p>এই মানসিকতা শুধু পাবলিক সার্ভিসে নয়, এই রোগ সর্বব্যাপী। আমরা যেকোনো সবল ব্যক্তি অপেক্ষাকৃত দুর্বলের ওপর প্রভুত্ব করা বা অযথা হয়রানি, অবজ্ঞা, অবহেলা করার মানসিক রোগাক্রান্ত। নিজের থেকে উঁচু স্তরে আপ্রাণ তৈলমর্দন এবং নিম্নে অবস্থানকারীদের প্রতি উল্টা আচরণ বাঙালির অস্থিমজ্জায় মিশে আছে। রক্তের উপাদানগুলোর সঙ্গে মিশে আছে যুগ-যুগান্তরব্যাপী।</p> <p>প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। জনগণ প্রদত্ত ট্যাক্সের টাকায় রাষ্ট্র চলে। আমরা যারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে বেতন, ভাতা, যানবাহন, আবাসনসহ অন্যান্য সুবিধাপ্রাপ্ত হই, তা জনগণের প্রদত্ত করের টাকায়। যে টাকা বেতন-ভাতা পাই, সেই টাকায় পতিতার সাবান কেনার সময় প্রদত্ত ভ্যাটের টাকাও মিশ্রিত আছে। সুইপার, রিকশাচালক, দিনমজুর, কাজের বুয়াসহ সবার প্রদত্ত ট্যাক্স-ভ্যাটের টাকায় প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতি, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সরকারি ভাতা-সহায়তাপ্রাপ্তরা বেতন-ভাতা ও সুবিধাদি পান। সংবিধান, আইন, নৈতিকতা—কোনো দিক দিয়েই কোনো জনপ্রতিনিধি বা সরকারি কর্মকর্তা লাট বাহাদুর নন। স্বাধীন দেশের জনপ্রতিনিধি, বিচারপতি, কর্মকর্তা—কেউ রাজকর্মচারী নন, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী। প্রজাতন্ত্রের সংবিধান কাউকে লর্ডের মর্যাদা দেয়নি। বেতন নেব জনগণের টাকায়, শপথ নেব সংবিধান সমুন্নত রাখার, অঙ্গীকার করব প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে কাজ করার; কিন্তু জনগণ স্যার না ডাকলে রুষ্ট হব, জনগণকে অনুগ্রহভাজন হিসেবে অবহেলা করব—এটি হতে পারে না। এই অবস্থান স্ববিরোধী।</p> <p>মূলত দুটি সামরিক শাসন, রাজনীতিবিদদের অনেকের নৈতিকতাবর্জিত অবস্থান, নিজেদের প্রভু ভাবার মানসিকতা এবং তুলনামূলক কম জ্ঞানার্জনের কারণে সরকারি কর্মকর্তাদের উত্তরণ ঘটানো যাচ্ছে না। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঠিক পথে পরিচালিত করার দায়িত্ব জনপ্রতিনিধিদের। জনপ্রতিনিধিদের ঔদাসীন্যের কারণে প্রজাতন্ত্রের পাবলিক সার্ভেন্টরা রাজতন্ত্রের যুগের মানসিকতা বহন করে চলেছেন।</p> <p>আবার জনগণের ভোটে নির্বাচিত অনেক জনপ্রতিনিধিকে নিয়োগকর্তা জনগণ স্যার না বললে বিরক্ত হতে দেখা যায়। সরকারি কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এটি নিন্দনীয়; কিন্তু জনপ্রতিনিধির ক্ষেত্রে আমি এই মানসিকতা ঘৃণিত মনে করি। কারণ জনপ্রতিনিধি নিয়োগের ক্ষেত্রে জনগণের অবদান অধিকতর সরাসরি ও কার্যকর। জনগণ তাঁদের হয়ে রাষ্ট্র বা স্থানীয় সরকার সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য নির্বাচিত করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দায়িত্ব প্রদান করে। রাষ্ট্রীয় ও স্থানীয় সরকারে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতিমুক্ত, দাম্ভিকতামুক্ত ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা এবং জনসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব অর্পণ করে। দায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির বেশি। এই দায় নির্বাচিতরা এড়াতে পারেন না।</p> <p>শুধু নির্বাচিত বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীই নন, আমরা যারা জীবনে এক দিনের জন্য সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যা লাভ করেছি, আমরাও দায় এড়াতে পারি না। প্রতিটি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য পাবলিক মানি বিনিয়োগ হয়। আমাদের শিক্ষা লাভের পেছনে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ যেহেতু নিয়োজিত হয়, সেহেতু আমরা যত বড় বিদ্বানই হই, আমাদের জন্য অর্থ প্রদানকারী জনগণ কখনোই নগণ্য নয়।</p> <p>রাষ্ট্রপতি থেকে ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্য পর্যন্ত প্রত্যেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, বিচারপতি ও সাংবিধানিক পদমর্যাদায় নিযুক্ত সবাইকে শপথ গ্রহণ করতে হয়। সিভিল সার্ভিসে যোগদানের আগ মুহূর্তে সবাইকে অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করে তা দাখিল করতে হয়। সামরিক বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অঙ্গীকারনামার বাইরেও পাসিং আউট প্যারেডে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ সামনে নিয়ে শপথ করেন।</p> <p>শপথ ও অঙ্গীকারের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা শপথগ্রহণকারীর সাংবিধানিক ও নৈতিক দায়িত্ব। সংবিধান যেহেতু জনগণের সুপ্রিমেসি নিশ্চিত করেছে, সুতরাং কোনো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বা পাবলিক সার্ভেন্ট জনগণকে স্যার বলতে প্রকাশ্যে বা আচরণে বাধ্য করতে পারেন না। সার্ভিসে সিনিয়রিটি, পদমর্যাদার ভিত্তিতে স্যার সম্বোধনের বিষয়টি একান্তভাবে সার্ভিসের নিজস্ব রীতি-নীতি। সেটি তাঁদের প্র্যাকটিসের বিষয়। জনগণকে স্যার সম্বোধনে বাধ্য করা সংবিধানবিরোধী। কেউ শ্রদ্ধা করে, ভালোবেসে বা স্বীয় স্বার্থ উদ্ধারের জন্য স্বীয় সিদ্ধান্তে কাউকে স্যার সম্বোধন করলে সেটি একান্তই ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু কেউ পাবলিক সার্ভেন্টকে স্যার ডাকতে বাধ্য নয়।</p> <p>প্রজাতন্ত্রের সুবিধাজনক পদে বসে জনগণের ওপর সুপ্রিমেসি করার প্রাগৈতিহাসিক প্রভুত্ববাদী মানসিকতার অবসান হোক। এক সাগর রক্তস্নাত আমাদের পবিত্র সংবিধানে লিখিত প্রস্তাব ও প্রতিটি ধারা-উপধারা সমুন্নত হোক। গণতন্ত্রের সর্বজনীন সংজ্ঞায় বর্ণিত গণপ্রজাতন্ত্রের মর্মবাণী বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হোক।</p> <p>লেখক : সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক</p>