বাংলাদেশ সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদে স্থানীয় সরকার প্রশাসন বিষয়ে করণীয় বিষয়গুলোর বর্ণনা রয়েছে। এর মূলকথা হলো, আইনশৃঙ্খলাসহ সব প্রশাসনিক ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের হবে। ৫৯ অনুচ্ছেদের অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রতি প্রশাসনিক একাংশে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রশাসনিক একাংশ কী, তারও ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা সংবিধানে বলা আছে।
জেলা, মহকুমা ও উপজেলার ইতিবৃত্ত
এ এম এম শওকত আলী

ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি মূলত একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ছিল। ১৭৫৭ সালে অবিভক্ত বাংলার শাসনভার গ্রহণের পর এ কারণেই তারা ভূমি কর আদায়ের দিকে নজর দিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে ভূমিকর স্থানীয় জমিদারদের মাধ্যমে আদায় করা হতো। কালেক্টরশিপ প্রথা প্রবর্তনের আগে ভূমিকর আদায়ের কর্মকাণ্ড তত্ত্বাবধানের লক্ষ্যে সুপারভাইজার নামে কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। ১৭৬৯ সালে এ প্রথার আওতায় ঢাকা, টিপারা (কুমিল্লা), রাজশাহী, যশোর ও দিনাজপুরে একজন করে সুপারভাইজার নিয়োগ করা হয়। ১৭৭২ সালে সুপারভাইজার পদবি বদল করে কালেক্টর নাম দেওয়া হয়। কালেক্টরদের মাধ্যমে সরাসরি ভূমিকর আদায় করা হতো। এ ধরনের ব্যবস্থাপনা ১৭৭৩ সালে রহিত করা হয়। ১৭৭৩ থেকে ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত ভূমি প্রশাসন সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় প্রাদেশিক রেভিনিউ কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত। ওই সময় পাঁচটি বৃহৎ জেলা, যেমন মেদিনীপুর, বর্ধমান, রাজশাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রামকে প্রদেশ বলা হতো। ১৭৮৬ সালে কালেক্টর প্রথা পুনরায় প্রবর্তন করা হয়। ওই বছর গভর্নর জেনারেল কর্নওয়ালিস বোর্ড অব রেভিনিউকে কালেক্টরশিপ করার পরিকল্পনা প্রণয়নের নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে কিছু নির্দেশনাও দেওয়া হয়। এক. প্রতিটি জমিদারি এলাকা একই কালেক্টরের অধীনস্থ থাকবে। দুই. জেলা নিকটতম পরগনাকে নিয়ে গঠন করা হবে। তিন. প্রতি জেলার ভূমি রাজস্ব ন্যূনতম পাঁচ লাখ টাকা হবে। মোট কালেক্টরশিপের সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ হবে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী অবিভক্ত বাংলায় ১৬টি কালেক্টরশিপ বা জেলার সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে ২১ মার্চ ১৭৮৭ সালে কলকাতা গেজেটে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছিল। এ বিজ্ঞপ্তিতে কালেক্টরশিপ শব্দের পরিবর্তে জেলা উল্লেখ ছিল।
অবিভক্ত বাংলার শাসনকার্য পরিচালনায় ভূমি রাজস্ব আদায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও অন্যান্য বিষয় যথা- আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও বিচার করার বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে এ দুটি বিষয় মোগল আমলের কাঠামোর কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। ১৭৯২ সাল-পূর্ববর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিজ নিজ এলাকায় জমিদাররাই পালন করতেন। এর জন্য তাঁদের নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনীও ছিল। ১৭৯২ সালে এ প্রথা পরিবর্তন করে প্রতি জেলায় থানা সৃষ্টি করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ওই জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিজ জেলায় থানা সৃষ্টির জন্য ক্ষমতাবান ছিলেন। তবে ১৮০৮ সালে থানা প্রশাসন সরাসরি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পুলিশ সুপারের পদ সৃষ্টি করা হয়। ওই সময় একমাত্র কলকাতা, ঢাকা ও মুর্শিদাবাদেই পুলিশ সুপার নিয়োগ দেওয়া হয়। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে প্রাথমিকভাবে একজন পুলিশ সুপারের কর্মক্ষেত্র কিছুটা বিশাল আকারের ছিল।
রেগুলেশন-১-এর আওতায় তদানীন্তন বাংলায় মোট ২৯টি বিভাগ সৃষ্টি করা হয়। বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাকে ওই সময় কমিশনার অব রেভিনিউ ও সার্কিট বলা হতো। সাধারণত তিন বা চারটি জেলা নিয়ে বিভাগ গঠন করা হয়। তখনকার বাংলায় কমিশনারের বিচারিক ক্ষমতা ভূমি প্রশাসনে সীমিত ছিল। ওই সময় থেকেই নিয়মিত পুলিশ প্রশাসন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনার চিন্তাভাবনা শুরু হয়। ১৮৬১ সালে এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য পুলিশ আইন প্রণীত হয় এবং একই সঙ্গে পুলিশের মহাপরিদর্শক পদও সৃষ্টি হয়। এ সময় সরকারের অন্য একটি লক্ষ্য ছিল ফৌজদারি মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি নিশ্চিত করা। এরই ধারাবাহিকতায় থানা ও জেলার মধ্যবর্তী প্রশাসনিক একাংশ হিসেবে মহকুমা প্রথা চালু হয়। কয়েকটি থানা নিয়ে মহকুমা গঠন করা হয়। ১৮৪২ সালের পর মহকুমা সৃষ্টি করার বিষয়টি তখনকার সরকারি বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তবে এর ব্যতিক্রম হিসেবে রাজশাহী জেলার সদর মহকুমার সৃষ্টি ১ মে ১৭৯৩ সালে হয় মর্মে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়। রাজশাহীর সদর মহকুমার বিষয়টির কথা বাদ দিলে বলা যায় যে ১৮৪২ থেকে ১৯০৪ সালের মধ্যে অবিভক্ত বাংলার সব কয়টি মহকুমা সৃষ্টি করা হয়। মোট সংখ্যা ছিল ৪৩। এ ক্ষেত্রে বলে রাখা প্রয়োজন যে বগুড়া জেলায় কোনো মহকুমা ছিল না।
প্রতি মহকুমায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার লক্ষ্যে ১৯১১ সালে নির্বাচিত কয়েকটি মহকুমায় উন্নয়ন সার্কেল সৃষ্টি করার জন্য পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করা হয়। উন্নয়ন সার্কেল সৃষ্টি করার ধারণার সূত্র হলো ১৯০৯ সালের রয়্যাল কমিশন আপত্তন ডিসেন্ট্রালাইজেশন ইন ইন্ডিয়া শীর্ষক প্রতিবেদন। এ প্রতিবেদনে সুপারিশ ছিল বাংলা ব্যতীত ভারতের অন্যান্য প্রদেশে জেলা ও থানার মধ্যবর্তী প্রশাসনিক স্তর হিসেবে তহশিল প্রথা চালু আছে। মূলত স্থানীয় সরকার তথা ইউনিয়নের কার্যাবলি তদারকির জন্য একাধিক ইউনিয়ন নিয়ে উন্নয়ন সার্কেল প্রথা সৃষ্টি করা হয়। ওই সময় ১৯১১ সালে পূর্ব বাংলার মুন্সীগঞ্জ মহকুমায় পরীক্ষামূলকভাবে উন্নয়ন সার্কেল প্রথার চালু করা হয়।
১৯৪৭-৭১ সময়ে তদানীন্তন পূর্ব বাংলা, যা ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে নাম পরিবর্তন করা হয়, সে প্রদেশে তিনটি বিভাগ, ১৬টি জেলা ও ৪৪টি মহকুমা ছিল। পরবর্তী সময়ে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা মহকুমার সমন্বয়ে নতুন কুষ্টিয়া জেলা গঠিত হয় (১৯৪৮)। ষাটের দশকের শেষার্ধে টাঙ্গাইল (১৯৬৯) ও পটুয়াখালী (১৯৬৮) মহকুমা জেলা হিসেবে সৃষ্টি হয়। এ সময়ে সাতটি নতুন মহকুমাও সৃষ্টি হয়। এ মহকুমাগুলো রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ (সেপ্টেম্বর ১৯৪৮), মেহেরপুর (সেপ্টেম্বর ১৯৪৮), চট্টগ্রাম সদর উত্তর ও দক্ষিণ (মে ১৯৬৯), মৌলভীবাজার (আগস্ট ১৯৬১), বরগুনা (ডিসেম্বর ১৯৬৮) ও ঝালকাঠি (জুন ১৯৭১)। খুলনা বিভাগও সৃষ্টি হয়। এর ফলে বিভাগের সংখ্যা হয় চার। ষাটের দশকের প্রথমার্ধে মৌলিক গণতন্ত্র প্রথার আওতায় প্রতি থানায় একটি করে উন্নয়ন সার্কেল স্থাপিত হয়। ১৯৬১ সালে পূর্ব বাংলায় মোট চারটি বিভাগ, ১৭টি জেলা, ৩৯৬টি থানা ও চার হাজার ৩২টি ইউনিয়ন ছিল।
১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রশাসনিক সংস্কারসংক্রান্ত একটি কমিটি গঠন করে। এর প্রধান ছিলেন তদানীন্তন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী। প্রশাসনিক সংস্কার কমিটির তিনটি প্রধান সুপারিশ- ক. মহকুমা প্রথার বিলুপ্তি; খ. বিদ্যমান মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নীত করা এবং গ. থানা প্রশাসন শক্তিশালীকরণ। ১৯৭৫ সালে সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু হয়। এর সঙ্গে মহকুমা প্রথা বিলুপ্ত করে ৬০টি জেলা সৃষ্টি হয়। তবে এ ব্যবস্থার আওতায় প্রতি জেলায় একজন করে গভর্নর নিয়োগ করা হয়। এ প্রথা সম্পূর্ণ কার্যকর করার আগেই আগস্ট ১৯৭৫ সালে সামরিক শাসনব্যবস্থা চালু হয়। এক সূত্র অনুযায়ী, একদলীয় শাসনব্যবস্থার আওতায় তিনটি মহকুমা জেলায় উন্নীত করা হয়- লক্ষ্মীপুর, রামগড় ও জয়পুরহাট। ১৯৭৭-৮০ সময়ে ১২টি নতুন মহকুমার সৃষ্টি হয়।
১৯৮৪ সালে প্রশাসনিক সংস্কারের আওতায় উপজেলা প্রথার প্রবর্তন করা হয়। এর আওতায় ৪৬০টি থানাকে উপজেলা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে মহকুমা প্রথা বিলুপ্ত করে জেলা সৃষ্টি হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে স্বল্পসংখ্যক উপজেলা যেমন, পঞ্চগড় জেলায় উন্নীত হয়। অন্যান্য উদাহরণ হলো লালমনিরহাট, ভোলা ও শেরপুর।
১৯৯১ সালে নির্বাচিত সরকার শাসনভার গ্রহণের পর উপজেলা প্রথা বিলুপ্ত করা হয়। ওই সময় সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা হয়। ওই সময় পর্যন্ত উপজেলাকে প্রশাসনিক একাংশ হিসেবে কোনো আইনের বলে ঘোষণা দেওয়া হয়নি। মূলত এ কারণে সরকার এ মামলায় জয়লাভ করে। পরবর্তী সময়ে প্রতি প্রশাসনিক একাংশে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার বাধ্যবাধকতার ফলে সব ধরনের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসংক্রান্ত আইনে প্রশাসনিক একাংশ শব্দটি সংযোজিত হয়। এর ফলে ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন আইনে প্রশাসনিক একাংশ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। জেলা প্রশাসনিক একাংশ হিসেবে ১৮৩৬ সালের আইনে ঘোষিত হলেও ১৯৭২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে জেলা পরিষদে কোনো নির্বাচিত স্থানীয় প্রতিনিধি নেই। এ এক বিরাট শূন্যতা।
লেখক : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান
- তুহিন খান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?
গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।
গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান—এই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার—সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘মব’ শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবে—এসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন
- ড. নিয়াজ আহম্মেদ

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।
আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।
আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
nahmed1973@gmail.com

কজন জানে জুলাই সনদ কী
- গাজীউল হাসান খান

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।
এ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ
- ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।
রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।
জুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।
এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।
‘যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।
বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।
তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।
এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।
সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd