একটা বড় প্রকল্প করতে গেলে যে ধাপগুলো পেরোতে হয় এবং একটা অত্যন্ত শক্তিশালী নদীকে মোকাবেলা করতে গেলে প্রকৌশলের ক্ষেত্রে যে সতর্কতা নিতে হয়, সেগুলো আমরা বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু করার সময় দেখেছি এবং শিখেছি। আমাদের যমুনা নদীও পৃথিবীর ১০টা বড় নদীর একটি। তবে সব নদীর গতি-প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হয়। এ কারণেই পদ্মা নদী সম্পর্কে তাত্ত্বিক জ্ঞান আমাদের থাকলেও ব্যাবহারিক জ্ঞান ছিল না।
বিজ্ঞাপন
আবার একটা বড় প্রকল্প করতে গেলে বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব সতর্কতা মানে সেগুলো আমরা বঙ্গবন্ধু সেতু করার সময় জেনেছি, শিখেছি। মূলত সেটাই আমরা পদ্মায় কাজে লাগিয়েছি। যেমন—একটা বিশেষজ্ঞ দল লাগবে। যখনই নকশায় কোনো পরিবর্তন করার প্রশ্ন উঠবে তখনই ওই বিশেষজ্ঞ দলের অনুমতি লাগবে। পর্যবেক্ষক-পরামর্শক লাগবে, মালিকপক্ষের অর্থাত্ সরকারের আরেকজন উপদেষ্টা লাগবে ব্যবস্থাপনা পরামর্শক হিসেবে। গুণগত মান দেখার জন্য একটি দল কাজ করবে। পর্যবেক্ষক-পরামর্শকরা অনুমতি না দিলে ঠিকাদার কোনো কাজ করতে পারবেন না। এসবই আমরা বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে শিখেছি।
যমুনা আর পদ্মায় নদীশাসন আকাশ-পাতাল ফারাক ছিল। এটা যমুনা থেকে শিখিনি, শিখেছি হার্ডেন ব্রিজ থেকে। হার্ডেন ব্রিজ এ ধরনের আরেকটি জটিল সেতু। হার্ডেন ব্রিজে গঙ্গার যে প্রবাহ এবং ভুয়াপুরে যমুনার যে প্রবাহ—ওই দুই শক্তির যোগফল হতে পারে পদ্মার পানি প্রবাহের শক্তি। পদ্মার শক্তি অনেক বেশি। যমুনাতে পানির প্রবাহ প্রতি সেকেন্ডে তিন মিটার; পদ্মায় প্রতি সেকেন্ডে সাড়ে চার থেকে পাঁচ মিটার। আর পদ্মায় স্রোতের সময় পানির শক্তি যমুনার ছয় গুণ।
আজ পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের সময় আমার বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতুর কথা খুব মনে পড়ছে। সৌভাগ্যবশত এই দুই সেতুতেই কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। দেখেছি পদ্মা সেতু নির্মাণে কত বাধা পেরোতে হয়েছে। প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিতে কত ভাবতে হয়েছে। পদ্মা সেতুর বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান জামিলুর রেজা চৌধুরী আজ বেঁচে নেই। তাঁর কথা খুব মনে পড়ছে। তিনিও বঙ্গবন্ধু সেতুর নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু সেতু তৈরির সময় আমাদের তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই সেই সেতু নির্মাণে আমরা অনেক জায়গায় আটকে গেছি। আমার বলতে আজ দ্বিধা নেই, যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মিত না হলে পদ্মার ওপরও সেতু নির্মিত হতো না। কেননা, আমরা বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তা কাজে লাগিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণে কাজ করেছি।
বড় চ্যালেঞ্জ পদ্মা নিজেই
পদ্মা সেতু নির্মাণে আমাদের অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল পদ্মা নদী নিজেই। সেতুতে যেসব বিদেশি বিশেষজ্ঞরা কাজ করেছেন, তাঁরা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি একটি নদীতে এমন স্রোত থাকতে পারে। এই নদী পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম খরস্রোতা নদী। পদ্মা নদীর আগে শুধু আমাজন নদীর অবস্থান। ফলে নদীর তলদেশে শক্ত মাটি খুঁজে পাওয়াই অনেক বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায়।
নদীর আচরণের কারণেও একবার নকশা পরিবর্তন করতে হয়েছে। যেসব জায়গায় শক্ত মাটি পাওয়া যাচ্ছিল না, সেসব জায়গায় প্রতিটি পাইলের নিজে একটি করে বেশি পাইলিং করা হয়।
বঙ্গবন্ধু সেতু যখন তৈরি হচ্ছিল তখন একটা ধাপের পর আরেকটা ধাপ করা হচ্ছিল। ফলে এতে কিছুটা সময় বেশি লেগে যায়। বিশ্বব্যাংকের চাপ, রাজনৈতিক জটিলতা তো ছিলই। কিন্তু যখন পদ্মা সেতু নির্মাণের আলোচনা শুরু হয় তখন প্রাক-সম্ভাব্যতা ও সম্ভাব্যতা যাচাই প্রায় একসঙ্গে করা হয়। এতে কিছুটা ঝুঁকি ছিল; কিন্তু এটা ছিল সময় বাঁচানোর কৌশল।
যমুনায় ফেরি বনাম সেতু
বিশ্বব্যাংক বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের পক্ষে ছিল না। সংস্থাটি সেতু নির্মাণে ঋণ দেওয়ার বিপরীতে উন্নত ফেরি চালুর জন্য ১০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু আমরা চাচ্ছিলাম সেতু তৈরি করতে। তখন এক ধরনের আলোচনা শুরু হয় ফেরি বনাম সেতু। বিশ্বব্যাংকের দুজন প্রতিনিধি বাংলাদেশে আসেন। তাঁদের সঙ্গে আমি আর জামিলুর রেজা চৌধুরী যুক্ত হই বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে। আবার আমরা দুজন অনেকটা গাইড হিসেবেও কাজ করি।
তাঁরা সরেজমিন বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া শুরু করল। এক সফরে দেখা গেল, ফেরিঘাটে লাইনে ট্রাক দাঁড় করিয়ে চালক গোসল করছেন। চালকের সঙ্গে আমাদের কথা হলো। চালক জানান, এটা তাঁদের নিয়মিত ঘটনা। একটা ট্রিপ শেষ করতে আসা-যাওয়া মিলিয়ে চার দিন লেগে যায়। এটা একটা ভালো তথ্য ছিল।
আবার সেখানকার একটা গ্রামে গিয়ে কৃষকদের সঙ্গে মতবিনিময় হলো। জানা গেল, কৃষকরা তাঁদের কৃষিপণ্য সঠিক সময়ে ভালো দামে বিক্রি করতে পারছেন না। এ রকম নানা কিছু সরেজমিনে দেখার পর বিশ্বব্যাংক সেতুতে ঋণ দিতে রাজি হয়।
রেলপথ বারবার বাধায়
যমুনায় বিশ্বব্যাংক রেলপথ যুক্ত করার পক্ষে ছিল না। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে। বিশ্বব্যাংক মনে করে, রেল লাভজনক প্রতিষ্ঠান নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলের পক্ষে ছিলেন। এর পরের ঘটনা আমরা সবাই জানি। সেগুলো আমি আর না-ই বললাম। পদ্মা সেতুতেও প্রথমে রেল ছিল না। পরে রেল যুক্ত করে আবার নকশা করা হয়।
বঙ্গবন্ধু সেতু যখন নির্মাণ করা হলো তখন সংযোগ সড়ক ছিল না। এতে সেতু চালু হওয়ার পর নতুন ভোগান্তি তৈরি হয়। আমাদের সেই অভিজ্ঞতা পদ্মা সেতুতে কাজে লেগেছে। সেতুর তৈরির আগেই এখানে সংযোগ সড়ক তৈরি করা হয়েছে।
পদ্মায় প্রথম হয় লালন শাহ সেতু
পদ্মা নদীতে পদ্মা সেতুই প্রথম সেতু না। এই বিষয়টাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। পদ্মা নদীতে প্রথম সেতু হচ্ছে লালন শাহ সেতু। এই সেতু পাবনার ঈশ্বরদীর সঙ্গে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার সংযোগ স্থাপন করেছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর ব্যবহার বাড়াতেই সেতুটি নির্মাণ করতে হয়।
পদ্মার বেলায় সেতু হওয়ার আগেই দক্ষিণাঞ্চলে অনেকগুলো বড় বড় সেতু করা হয়েছে। ফল একটা—যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরি হয়ে গেছে পদ্মাকে ঘিরে।
পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। এটি এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় সেতু। এর পরই রয়েছে ৪.৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বঙ্গবন্ধু সেতু। আর লালন শাহ সেতুর দৈর্ঘ্য ১.৭৯ কিলোমিটার।
পদ্মার স্রোত কেন এত শক্তিশালী
ভারতে যে নদীর নাম গঙ্গা। আমাদের দেশে সে নদী পদ্মা। গঙ্গা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা দিয়ে। সেখানে সে পদ্মা নাম ধারণ করেছে। বাংলাদেশে প্রবেশ করে এটি রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী হয়ে পৌঁছায় গোয়ালন্দ-দৌলতদিয়া-আরিচা পর্যন্ত। দৌলতদিয়ায় পদ্মা ও যমুনা মিলিত হয়। তাই এখানে নদীতে পানির স্রোত খুবই ভয়ংকর। কিন্তু গঙ্গাতে পানির এত স্রোত নেই।
ভরা বর্ষায় পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ চালিয়ে যাওয়া ছিল সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। এমনিতেই পদ্মা নদীর শক্তি অনেক বেশি, বর্ষার সময় সে আরো ভয়াবহ হয়ে ওঠে। নদীর গভীরতা বেড়ে প্রায় ৬০ মিটার পর্যন্ত হয়ে যায়। তখন সেতু নির্মাণের কাজে ব্যবহূত বড় ক্রেন, বার্জ আর ড্রেজার পর্যন্ত কাঁপতে দেখা গেছে।
আরেকটা বিষয় খেয়াল রাখা দরকার, সিরাজগঞ্জে ব্রহ্মপুত্র ১৪ কিলোমিটার চওড়া। রাজশাহীর দিকে পদ্মা ছয় কিলোমিটার। এ রকম দুটি মিলিত ধারা মাওয়ার কাছে তিন কিলোমিটার চওড়া এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে মাওয়ায় পদ্মা নদীতে পানির স্রোতের বেগ কতটা, তা কিছুটা হলেও অনুমান করা যায়।
এমন নানা ধরনের বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আজ পদ্মা সেতু চালু হচ্ছে। এখন এই অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের এক জায়গায় জড়ো করে রাখা উচিত। আমি আর জামিলুর রেজা চৌধুরী অনেক কিছু সামনে থেকে দেখেছি। তাঁর মতো মানুষগুলো আজ নেই। কিন্তু ভবিষ্যতে পদ্মার মতো বড় প্রকল্প করতে হলে এই সেতুর অভিজ্ঞতাগুলো পরের প্রজন্মের কাজে লাগবে। তাই সরকারের উচিত এগুলো এখনই নথিবদ্ধ করা।
লেখক : পদ্মা সেতুর বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য নদী বিশেষজ্ঞ, ইমেরিটাস অধ্যাপক