<p>ফরাসি অস্তিত্ববাদী দার্শনিক ও সাহিত্যিক জ্যঁ পল সার্ত্রে তখন শিক্ষকতা করছেন ফ্রান্সের উত্তর-পশ্চিমের শহর ল্য আভ্-এর লিসিতে। ছাত্রদের সঙ্গে সার্ত্রের সম্পর্ক ছিল মধুর। তিনি শিক্ষকতায় যোগ দেওয়ার পরেই ছাত্ররা জানতে পারল যে জনৈকা সিমোন দা বোভোয়ার রুঁয়েতে শিক্ষকতা করছেন এবং তাঁর প্রতি সার্ত্রের রয়েছে প্রেম। প্রতি বুধবার বিকেলে তড়িঘড়ি করে ক্লাস শেষ করে রুঁয়েগামী ট্রেন ধরেন সার্ত্রে। এক বুধবার ছাত্ররা একটি তালা এনে তাদের মাস্টারমশাইয়ের ওভারকোটের বোতাম আটকে রাখল। কোটটি কোনোভাবেই খুলতে পারেন না সার্ত্রে। ওদিকে ট্রেনের সময় হয়ে গেছে। কী করেন! অগত্যা কোট ছাড়াই তীব্র শীতবিকেলে রুঁয়ের ট্রেন ধরলেন।</p> <p>‘ল্য দ্যজিয়ম’ বা ‘সেকেন্ড সেক্স’ এবং ‘লে মাঁদারে’ উপন্যাসের জন্য বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক, দার্শনিক সিমোন দা বোভোয়ার ছিলেন জ্যঁ পল সার্ত্রের অন্তরঙ্গ সঙ্গী, যাকে বলা যায় শিল্পসঙ্গী, চিন্তাসঙ্গী। দুজনের পরিচয় ১৯২৮ সালে, যখন তাঁরা সোরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে অধ্যয়নরত। পরের বছর সার্ত্রে ও সিমোন দুজনই অধ্যাপক নির্বাচনের লক্ষ্যে আয়োজিত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিলেন। সার্ত্রের বয়স তখন ২৩ বছর এবং সিমোনের ২১ বছর। পরীক্ষায় সার্ত্রে অর্জন করলেন প্রথম স্থান এবং সিমোন দ্বিতীয় স্থান।</p> <p>পরবর্তীকালে পরীক্ষকরা বলেছিলেন, দুজনের মধ্যে কাকে প্রথম করবেন, এই সিদ্ধান্ত নিতে তাঁদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। সব পরীক্ষকই স্বীকার করলেন যে দুজনের মধ্যে সিমোনই হলেন প্রকৃত দার্শনিক, যদিও পরবর্তীকালে সিমোন তা মানেননি। আজীবন তিনি সার্ত্রের শিষ্য হিসেবেই পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু এই শিষ্যত্ব গুরুর অন্ধ-অনুকরণ নয়, অন্ধভক্তি নয়, তিনি ছিলেন সার্ত্রের দার্শনিক চিন্তার বিচার-বিশ্লেষণের তীক্ষ সমালোচক।</p> <p>সার্ত্রে ও সিমোন বিবাহসূত্রে আবদ্ধ না হয়েও ঘোষিতভাবে অন্তরঙ্গ জীবন যাপন করেছিলেন। এই সম্পর্কের কিছু শর্ত তাঁরা নিজেরাই ঠিক করে নিয়েছিলেন। যেমন—পরস্পরের ওপর কোনোরূপ কর্তৃত্ব করবেন না, প্রত্যেকে একে অপরের ‘স্পেস’ বা পরিসরকে মর্যাদা দেবেন, উভয়ে স্বচ্ছ থাকবেন, কোনো কিছু গোপন করবেন না। একাধিক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগও ছিল সেসব শর্তে। শেষোক্ত শর্তটিই সিমোনের জীবনে জটিল সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছিল, যখন তাঁর ছাত্রী অলগার সঙ্গে সার্ত্রের নিবিড় অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল।</p> <p>অলগাও ছিলেন দার্শনিক, মেধাবী, সুন্দরী ও আকর্ষণীয়। সার্ত্রে ও অলগার সম্পর্কের অন্তরঙ্গতা স্বীকার না করে সিমোনের উপায় ছিল না। সার্ত্রে ও সিমোন দুজন তো পরস্পরকে চূড়ান্ত স্বাধীনতা আগেই দিয়ে রেখেছেন। এর কারণে অলগাকে শাসন করার কোনো সুযোগ ছিল না সিমোনের। অলগাকে তিনি সার্ত্রের চোখ দিয়েই দেখার চেষ্টা করেছেন, অলগার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হননি। ফলে তিনজনের মধ্যে তৈরি হয়েছিল এক ত্রিকোণ সম্পর্ক। এই ত্রিকোণ সম্পর্কের রসায়ন সিমোনকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল বটে, কিন্তু তাতে তাঁর কিছুই করার ছিল না। কেননা তাঁরা তো আগেই ব্যক্তিস্বাধীনতায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।</p> <p>সিমোনও প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছেন বয়সে এক বছরের ছোট মার্কিন প্রেমিক নেলসন আলগ্রেনের সঙ্গে। আলগ্রেন এসেছিলেন তাঁর জীবনে উল্কার মতো। আলগ্রেনের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন নানা স্থানে। কিন্তু এই প্রেমে তিনি স্থির থাকতে পারেননি, আলগ্রেনকে ছেড়ে আবার তিনি ফিরে যান পুরনো প্রেমিক সার্ত্রের কাছেই। আলগ্রেনের সঙ্গে প্রেম করায় সার্ত্রের বুঝি খুব অভিমান হয়েছিল। এক চিঠিতে তিনি সিমোনকে লিখেছেন, ‘তোমার জীবনে আমি এখন শ্বেত মর্মরে বাঁধাই কবর।’ পাল্টা চিঠিতে সিমোন জবাব দেন, ‘না, আপনি আমার জীবনে শ্বেত সমাধি বা সাদা পাথরে বাঁধানো কোনো কবর নন।’</p> <p>সার্ত্রেকে লেখা সিমোনের একটি চিঠি অনুবাদ করেছেন কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক অদিতি ফাল্গুনী। সেই চিঠিতে সিমোন সার্ত্রেকে ‘আমার ছোট্ট মিষ্টি মানুষ’ সম্বোধন করেছেন। এ সম্বোধনের কারণ হয়তো এই যে সার্ত্রের দেহের গঠন ছিল ছোটখাটো, ছোটবেলা থেকেই তাঁর একটি চোখ ছিল দুর্বল। সিমোন লিখেছেন, ‘আমার ছোট্ট মিষ্টি মানুষ, আমার ছোট্ট প্রিয় আত্মা ওগো, আপনি আমাকে যে ছোট্ট, সজীব চিঠিটা লিখেছেন, সেটা কেমন যে আমার মনকে নাড়া দিল। কারণ আমি জানি এই চিঠির পুরোটাই সত্য না। আপনি তো কোনো শ্বেত সমাধি নন, আপনি অন্য এক হৃদয়।...আমি এটাও জানি যে আপনাকে আমি কোনো দিন হারাব না, জীবনে যে-ই আসুক বা যা কিছুই ঘটুক না কেন, আপনি সব সময়ই থাকবেন আমার ছোট্ট বন্ধু।’</p> <p>সিমোন আরো লিখেছেন, ‘আপনি আমার অভাব বোধ করছেন জেনে সত্যি অভিভূত বোধ করছি, প্রেম আমার! কারণ যদি কখনো এমন হয় যে একটিবারের জন্যও আপনি আমার অভাব বোধ করছেন না, যেহেতু এই দিনগুলোতে আপনার জন্য কোনো জায়গা আমার রাখা হচ্ছে না, তবু আপনি আমার দিগন্ত, আমার মহাবিশ্ব এবং আমার জীবনে আনন্দময় যা কিছু আসে, তা যে আপনার আলোতেই আলোকিত। সত্য এটাই যে আমি আপনাকে কখনো ছেড়ে যাইনি, আমি আপনাকে কখনো ছাড়তে পারি না। আপনি আমার আরেকটা জীবন।’</p> <p>অলগার সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন করে সার্ত্রে সিমোনকে দেওয়া কোনো প্রতিশ্রুতিই লঙ্ঘন করেননি। তাঁরা একসঙ্গে থাকতেন না আবার লিভ টুগেদারও করতেন না। দুজন আজীবন প্যারিসের পৃথক দুটি হোটেলে থেকেছেন। বিয়ে করে একসঙ্গে থাকা আর্থিকভাবে সুবিধাজনক মনে হলেও তাঁরা এ পথ বেছে নেননি। কারণ তাঁদের মনে হয়েছে বিয়ে, এমনকি একত্র বাস মানুষের জন্য ক্ষতিকর। দুজনই দুটি কন্যাসন্তান দত্তক নিয়েছিলেন এবং নিজ নিজ দায়িত্বে তাদের প্রতিপালন করেছেন।</p> <p>সার্ত্রে ছিলেন সুবক্তা। কথা দিয়ে মানুষকে কাছে টানতে পারতেন। এ কারণে তাঁর প্রতি ছিল অনেক নারীর আকর্ষণ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই আকর্ষণে কোনো ছেদ পড়েনি। শেষ বয়সে তাঁর চারবার হার্ট অ্যাটাক হওয়ায় মুখের পেশি ও ঠোঁট বেঁকে গিয়েছিল। চোখ দুটি প্রায় অন্ধ, হাঁটুতে ব্যথা। এর পরও অনেক নারী-পুরুষের সঙ্গে তিনি নতুন নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। গবেষক শেফালী মৈত্র তাঁর ‘উজানে মেয়ে’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘পরিচিত নিকটজনদের মধ্যে রীতিমতো একটা রেষারেষি ছিল, কে সার্ত্রের কত কাছে আসতে পারে, তাই নিয়ে হতো মন-কষাকষি।’ এ সময়েও সার্ত্রের ওপর অধিকারের জায়গায় সিমোন দা বোভোয়ারের দখলদারি কিছু কম ছিল না।</p> <p>তিরিশের দশকের শেষ দিকে সামরিক কাজে যোগদান বাধ্যতামূলক ছিল বলে প্রায় দুই বছর সার্ত্রেকে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তুর অঞ্চলে থাকতে হয়েছিল। তিনি ছিলেন আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের কেরানি। সার্ত্রে যখন সমরাঙ্গনে, সেসব দিনের একদিন সিমোনের এক ছাত্রী সিনেমা হলের বাইরে থেকে একটি সাইকেল চুরি করে এনে সিমোনকে দেন। এরপর সার্ত্রে যখন অবসর যাপনে প্যারিসে এলেন, তখন সেই ছাত্রী অনুরূপভাবে সিনেমা হলের বাইরে থেকে আরেকটি সাইকেল চুরি করে সার্ত্রেকে দিতে চাইলেন। চুরি করা সাইকেল গ্রহণে সার্ত্রের আপত্তি ছিল। কিন্তু ছাত্রীটির যুক্তি ছিল যে সার্ত্রে একটি সাবেকি নৈতিক আদর্শের বশবর্তী হয়ে সাইকেল প্রত্যাখ্যান করছেন। তিনি যেন বলতে চাইছেন চুরি করা সব অবস্থায়ই অন্যায়। তাহলে নৈতিক বিচারকে অব্যতিক্রমী বলতে হয়। এরপর আর আপেক্ষিক নৈতিক বিচারের সপক্ষে কথা বলা যাবে না। এটি একজন এক্সিসটেনশিয়ালিস্টের (সার্ত্রের দর্শন) অবস্থান হতে পারে না। এর আগে সার্ত্রে সব ক্ষেত্রেই কনটিনজেন্সি বা অধ্রুবত্বের পক্ষে প্রশ্ন করেছেন, তাহলে এ ক্ষেত্রেই বা তার ব্যতিক্রম কেন হবে? তা ছাড়া এই সাইকেল সিনেমা হলে ফেরত নিয়ে গেলে কোনো লাভ হবে না। কারণ তার মালিককে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। যুক্তির কাছে হেরে গিয়ে সার্ত্রে সাইকেলটি গ্রহণ করলেন। এরপর দুটি চুরি করা সাইকেল নিয়ে সিমোন আর সার্ত্রে দীর্ঘ ভ্রমণে গেলেন।</p> <p>সাহিত্যিক জ্যঁ পল সার্ত্রে ও সিমোন দা বোভোয়ার দুজনে চিরকাল সমাজের মূলস্রোতের বিরুদ্ধে চলেছেন। পূর্ব সংস্কারের অনুবর্তী হয়ে বা অপরের পরামর্শে তাঁরা জীবনকে পরিচালিত করেননি। দুজনের এই সম্পর্ক ছিল আমৃত্যু।</p>