চট্টগ্রামের বাতিঘরে চারুকলার শিক্ষার্থী ও শিল্পী পরিবেষ্টিত রুথ কেলি ছবি : লেখক
রুথ কেলি একজন আইরিশ কবি, অনুবাদক, গবেষক ও চিত্রসমালোচক। থাকেন উত্তর ইংল্যান্ডে। পেশাগতভাবে যুক্ত আছেন অক্সফোর্ড শহরের একটি মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে। ২০১৯ সালের গোড়ার দিকে তিনি তাঁর সহকর্মী এমিলি ফ্লাওয়ারসহ চট্টগ্রামে এসেছিলেন চারুকলা ইনস্টিটিউট ও চেরাগি ‘আর্ট শো’ খ্যাত শিল্পসংগঠন যোগের সঙ্গে শিল্প, সাহিত্য ও সমাজ-রাজনীতি বিষয়ক একটি যৌথ গবেষণাকর্মে।
বিজ্ঞাপন
তো, আমাদের সেই অসম্পূর্ণ আন্তর্মহাদেশীয় সাহিত্য প্রকল্প থেকেই সুজান কিগুলির একটি মৌলিক কবিতা এবং রুথের শ্রুতলিখনে তাঁর আরেকটি মুক্তগদ্যের অনুবাদ পেশ করা হলো এখানে শিলালিপির পাঠকদের জন্য। সুজানের কবিতাটিতে আমরা প্রকৃতি ও প্রতিবেশের যে অন্তর্লীন বৈশ্বিকতা, তার সঙ্গে স্মৃতি ও নস্টালজিয়ার এক আশ্চর্য মেদুর মিথস্ক্রিয়ার মুখোমুখি হই। আর তাঁর স্বদেশীয় ঐতিহ্য, মৌখিক সাহিত্যের নমুনাস্বরূপ শ্রুতলিখিত মুক্তগদ্যটি যেন সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার সঙ্গে শিল্প ও রাজনীতির পারস্পরিক সম্পর্কেরই একটি দার্শনিক সন্দর্ভের সংক্ষিপ্তসার। সব শেষে চট্টগ্রামের ইতিহাস ও উৎপত্তির সঙ্গে জড়িত কিংবদন্তির চেরাগি পাহাড়ের পৌরাণিক আলোর নিচে দাঁড়িয়ে খোদ রুথ কেলি রচিত একটি কবিতার তর্জমাও রইল এর সঙ্গে, যেখানে স্থানিক নিসর্গের জলজ জাদুস্পর্শে দুলে উঠতে দেখি আমরা দূর অতীতের কোনো স্মৃতিময় সান্দ্র চলচ্ছবিকে।
সকালের সঙ্গে সংলাপ
সুজান নালুগুয়া কিগুলি
আজ সকালে বাতাস আমার চোখেমুখে
ঝাপটা দেয়, বরফ ঝরে পড়ে আমার
হাতে, আর হাতের তালু
কলার মতো হলুদাভ।
কল্পনায় আমি মিশে যাই
মাঠের বুকে শরতের ছড়িয়ে দেওয়া
সোনালি, বাদামি ও সরষে রঙের সঙ্গে।
এই শুদ্ধ সকালে একটি কাঠবিড়ালি
আমাকে চকিতে পাশ কাটিয়ে যায়, এর রুপালি ধূসর
গালিচা লেজ প্রসারিত হতে হতে ফের কুঁকড়ে আসে।
একটু থামে, এপাশ-ওপাশ করে, পাগুলোকে
হাতের মতো নাচায়, কিছু একটা কুড়ায়—
হয়তো বাদাম, কিংবা শস্যবীজ
একটু নেড়েচেড়ে তারপর ঠুকরে খায়।
কেবল হাঁটু-কাঁপানো শীত আমাকে
পথচলার কথা মনে করিয়ে দেয়;
আমি ইয়র্কশায়ারের ফ্যাকাসে সকালে
কাঠবিড়ালিটিকে রেখে যাই।
আমি শরতের ছিঁচকে বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে যাই
সবচেয়ে আবেদনময়ী পাতাদের বেছে নিতে নিতে :
ব্রিটেনের রাজকীয় প্রহরীদের লাল-সাদা দস্তানার রঙের মতো
বোঁটাঅলা শুকনো ও খরখরে পাতাসমূহ, নাকি
উগান্ডার প্রাতঃকালীন আকাশপথের মতো,
সমুজ্জ্বল তামাটে পাতার দল।
সুতীব্র শীত সত্ত্বেও আমার হৃদয় ছবিদের আঁকড়ে ধরে,
লিডসের কোনো এক কুয়াশাসিক্ত সকালের সঙ্গে কথা বলে।
আমি এই জায়গাটির উপাসনাতে মগ্ন
নিজেকে আবিষ্কার করি পুনরায়;
আমার নিজের জায়গা থেকে অনেক দূরে,
আমার চোখজোড়া তাকেও ছাপিয়ে যেতে চায়।
মনে হয় পেয়েছেন, তার পরই
দেখেন, নেই
সুজান নালুগুয়া কিগুলি
শ্রুতলিখন : রুথ কেলি
শিল্প, আমি মনে করি কল্পনা। আমি এও মনে করি, যখন এটা কল্পিত হচ্ছে, তখন সেটা আসলে কল্পনাকারীর মস্তিষ্কের উন্মাদনা। এবং আমি জানি না, একজন আইনজীবী আমার মাথার সেই উন্মাদনার সঙ্গে কিভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। আমাদের সরকার—তাদেরকে এই কৃতিত্ব দেওয়া হোক—চায় আমরা কামনা করি, এই কামনা বস্তুসামগ্রীর, যেন আমরা সেসব ব্যবহার করে দেখি। সীমানা প্রসারণের মাধ্যমে আপনি রাজনৈতিক হয়ে ওঠেন না। কেননা আপনি জায়গা বদল করছেন, আপনি আপনার সীমানা অতিক্রম করে নিজেকে প্রলম্বিত ও প্রসারিত করছেন এবং বিস্ফোরিত হচ্ছেন। ফলে আজকের দিনে রাজনীতিকে যেভাবে পাঠ করা হয়—ক্ষমতাকে আয়ত্ত করা এবং তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, সেই অর্থে আপনার রাজনৈতিক হয়ে ওঠাটা খুব কঠিন। এটা বরং বস্তুসমূহকে উল্টো করে ঘূর্ণি লাগিয়ে দেওয়া, যেন কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকে আর। মনে হয় পেয়েছেন, তার পরই দেখেন, নেই। (কাম্পালা, মার্চ ২০১৮)
চেরাগির পর
রুথ কেলি
আমাদের জন্ম হয়েছে
যেসব টানাপড়েনের মধ্যে
আর আমরা নিজেরা বেছে নিয়েছি যেসব।
নদীকিনারের ভেজা কাদায়
আমাদের পা ডুবে যায়।
দূরের আলোরা চমকায়।
এত দূর অবধি পাখিরা গান গায়।
তোমার বাড়ানো হাত
মঙ্গল গ্রহে ঘূর্ণি লাগিয়ে দেয়
দিনের ঘনীভূত নীলের
বিপরীতে যা রং বদলায়।
জোয়ারের জল পাশ ফিরে ক্রমে ফুলে ওঠে।
আলোকিত হয়ে ওঠে পুরনো সিনেমা হল :
ছবি শুরু হলো বলে!
চট্টগ্রাম, জানুয়ারি ২০২০