উনিশ শ পঁচাত্তর সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে শহীদ হন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-৭৫)। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত দেশি-বিদেশি শত্রুর ষড়যন্ত্রে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। কতিপয় বিপথগামী কুচক্রী দেশদ্রোহী সেনা সদস্য প্রত্যক্ষভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটালেও পেছন থেকে কলকাঠি নাড়িয়েছে দেশি-বিদেশি অনেক ষড়যন্ত্রকারী ও রাষ্ট্রীয় এজেন্ট। কিন্তু কেন? কারণ একটাই।
আগস্ট ট্র্যাজেডি ও বর্তমান বাংলাদেশ
বিশ্বজিৎ ঘোষ

কী ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন? সহজ কথায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক এবং শোষিত মানুষের সামূহিক মুক্তিই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিচেতনার মূল কথা।
মুক্তি-স্বাধিকার-স্বাধীনতা—বঙ্গবন্ধুর এই রাজনৈতিক দর্শনের যাত্রা শুরু চল্লিশের দশকের মধ্যলগ্ন থেকেই। উনিশ শ সাতচল্লিশ থেকেই তিনি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দর্শনের কথা ঘোষণা করেছেন এবং সেই দর্শনের বাস্তবরূপ দেওয়ার জন্য জীবন বাজি রেখে নানা কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ—সব আন্দোলন-সংগ্রামেই বঙ্গবন্ধুর প্রগতিশীল রাজনৈতিক দর্শন এবং সুষম বণ্টনভিত্তিক অর্থনৈতিক বিশ্ববীক্ষা সর্বদা ক্রিয়াশীল ছিল। জীবনভর তিনি দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, কামনা করেছেন শোষিত মানুষের মুক্তি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন, প্রকৃত প্রস্তাবেই, একজন জনদরদি রাজনৈতিক নেতা। সুদীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বকীয় প্রজ্ঞা আর অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি একটি নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শনে উপনীত হয়েছিলেন। সেই রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি ছিল জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র দুই বিপ্রতীপ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বঙ্গবন্ধু মেলাতে চেয়েছেন অভিন্ন মোহনায়। তাঁর মতে, এই মিলনটাই হতে পারে শোষিত মানুষের মুক্তির একমাত্র দার্শনিক ভিত্তি। গণতন্ত্র সকল মানুষের সমতার কথা বলে না, কাগজে-কলমে থাকলেও সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের সুযোগ বাস্তবে তেমন দৃশ্যগোচর নয়। অন্যদিকে সমাজতন্ত্রে অর্থনীতিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণে ক্রমে গৌণ হয়ে পড়ছে রাজনীতি—বঙ্গবন্ধু এ কথা ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। অভিন্ন কথা ভেবেছিলেন প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার (১৮৬৪-১৯২০)। ওয়েবারের মতে, “সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অর্থনীতিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার ফলে একসময় রাজনীতি গৌণ হয়ে যাবে এবং ‘সর্বহারার একনায়কত্বের’ পরিবর্তে ক্রমে দেখা দেবে ‘সরকারি আমলাদের একনায়কত্ব’।”
গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র—এই দুই রাজনৈতিক দর্শনের অন্তর্গত শক্তি ও দুর্বলতা যথার্থই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তৃতীয় বিশ্বের অসামান্য এক রাজনৈতিক নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুই ব্যবস্থার দুর্বলতাকে পাশ কাটিয়ে তিনি শক্তির সামবায়িক রূপের এক নতুন দর্শন দিয়েছেন বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের জন্য। এ কারণেই ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আখ্যায়িত করেন বিশ্বের শোষিত মানুষের মহান নেতা হিসেবে, এ কারণেই ইউনেসকো তাঁকে আখ্যায়িত করে ‘বিশ্ববন্ধু’ হিসেবে। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ভাবনার মূল নির্যাসটা এখন একবার তাঁর কথাতেই দেখা যেতে পারে।
উনিশ শ বাহাত্তর সালের ৪ সেপ্টেম্বর খসড়া শাসনতন্ত্র অনুমোদন উপলক্ষে গণপরিষদে দেওয়া ভাষণে গণতন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজস্ব দর্শন ব্যাখ্যা করে বলেন : ‘আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র সেই গণতন্ত্র, যা সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করে।... আমরা দেখেছি যে—গণতন্ত্র যেসব দেশে চলেছে দেখা যায়, সেসব দেশে গণতন্ত্র পুঁজিবাদের প্রটেকশন দেওয়ার জন্য কাজ করে এবং সেখানে প্রয়োজন হয় শোষকদের রক্ষা করার জন্যই গণতন্ত্র ব্যবহার। সে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা চাই শোষিতের গণতন্ত্র এবং শোষিতের গণতন্ত্রের অর্থ হলো, আমার দেশে যে গণতন্ত্রের বিধিলিপি আছে, তাতে সেসব বন্দোবস্ত করা হয়েছে, যাতে এদেশের দুঃখী মানুষ রক্ষা পায়, শোষিতরা যাতে রক্ষা পায়, তার ব্যবস্থা নাই। সেজন্য আমাদের গণতন্ত্রের সাথে অন্যের পার্থক্য আছে।... যে চক্র দিয়ে মানুষকে শোষণ করা হয়, সেই চক্রকে আমরা জনগণের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করতে চাই।... শোষিতকে রক্ষা করার জন্য এই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হবে। সেজন্য এখানে গণতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের সংজ্ঞার সঙ্গে অনেকের সংজ্ঞার পার্থক্য হতে পারে।’ উনিশ শ পঁচাত্তর সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসভায় নিজস্ব গণতন্ত্র-ভাবনা ব্যাখ্যা করে বঙ্গবন্ধু বলেন : “আমরা চাই শোষিতের গণতন্ত্র। আমি বিশ্বাস করি না, ক্ষমতা বন্দুকের নলে। আমি বিশ্বাস করি, ক্ষমতা বাংলার জনগণের কাছে। জনগণ যেদিন বলবে, ‘বঙ্গবন্ধু ক্ষমতা ছেড়ে দাও’—বঙ্গবন্ধু তারপর একদিনও রাষ্ট্রপতি, একদিনও প্রধানমন্ত্রী থাকবে না। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করে নাই। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছে দুঃখী মানুষকে ভালোবেসে, বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছে শোষণহীন সমাজ কায়েম করবার জন্য।... আমরা চাই শোষিতের গণতন্ত্র, আমরা চাই না শোষকের গণতন্ত্র।”
গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সম্মিলিত দর্শন দিয়ে বঙ্গবন্ধু বিশ্বের শোষিত মানুষের মুক্তির নতুন পথ নির্মাণ করতে চেয়েছেন। তিনি প্রত্যাশা করেছেন শোষিত-বঞ্চিত-উত্পীড়িত মানুষের মুক্তি, প্রত্যাশা করেছেন সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদের শৃঙ্খল থেকে পরাধীন জাতিসমূহের মুক্তি। বঙ্গবন্ধু প্রত্যাশা করেছেন ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন। উনিশ শ পঁচাত্তরের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসভায় লক্ষ মানুষের সামনে তিনি ঘোষণা করেন : ‘সমাজে পরিবর্তন চাই। এই যে কী হয়েছে সমাজের, সমাজ ব্যবস্থায় যেন ঘুণ ধরে গেছে। এই সমাজের প্রতি চরম আঘাত করতে চাই। যে আঘাত করেছিলাম পাকিস্তানীদের, সে আঘাত করতে চাই এই ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থাকে।... যে নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি আমি, তাতে গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে।... পাঁচ বছরের প্ল্যানে বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে একটি করে কো-অপারেটিভ হবে।... এর জমি মালিকের থাকবে। কিন্তু তার ফসলের অংশ সবাই পাবে। প্রত্যেকটি বেকার, প্রত্যেকটি মানুষ, যে মানুষ কাজ করতে পারে, তাকেই এই কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে। এগুলি বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। পয়সা যাবে তাদের কাছে, ফার্টিলাইজার যাবে তাদের কাছে, টেস্ট রিলিফ যাবে তাদের কাছে, ওয়ার্কস প্রোগ্রাম যাবে তাদের কাছে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিলে এই জন্যই ভিলেজ, কো-অপারেটিভ হবে। আমি ঘোষণা করছি আজকে যে, পাঁচ বছরের প্ল্যানে প্রত্যেকটি গ্রামে পাঁচ শত থেকে এক হাজার ফ্যামিলি পর্যন্ত নিয়ে কম্পালসারি কো-অপারেটিভ হবে। আপনার জমির ফসল আপনি নেবেন, অংশ যাবে কো-অপারেটিভের হাতে, অংশ যাবে গভর্নমেন্টের হাতে।’
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেও বঙ্গবন্ধু যথার্থ গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন—পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ জন মানুষের বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। মাও জেদংয়ের নেতৃত্বে উনিশ শ আটচল্লিশ সালের চীন বিপ্লবের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। চীন বিপ্লব সম্পর্কে তাঁর জানার আগ্রহ ছিল ব্যাপক। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক সরকার যখন তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি করে রেখেছে, সে সময়ে, উনিশ শ একান্ন সালের ১২ সেপ্টেম্বর তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার কাছে লেখা বঙ্গবন্ধুর একটি চিঠির অংশবিশেষ এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ওই চিঠিতে বঙ্গবন্ধু লেখেন : ‘চিন্তার কোনই কারণ নাই। জেলখানায়ও যদি মরতে হয় তবে মিথ্যার কাছে কোন দিন মাথা নত করবো না। আমি একলা জেলে থাকাতে আপনাদের কোন অসুবিধা হবে না। কাজ করে যান, খোদা নিশ্চয়ই সাহায্য করবে। আমার জন্য কিছুই পাঠাবেন না। আমার কোন কিছুরই দরকার নাই। নূতন চীনের কিছু বই যদি পাওয়া যায় তবে আমাকে পাঠাবেন।’ চীন সম্পর্কে জানার এই আগ্রহ কেন? তিনি কি তখনই শোষিতের মুক্তির জন্য সমাজতন্ত্রের কথা ভাবতে শুরু করেছেন?
কেবল স্বাধীনতা নয়, বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তি। সে জন্য শোষিত মানুষের স্বার্থের কাছে নিজের স্বার্থকে তিনি জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। বিশ্বের শোষিত মানুষের মুক্তিই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। সেই মুক্তির সংগ্রামে তিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের দিকে, পরিবারের দিকে কখনো দৃষ্টি দেওয়ার সুযোগ পাননি বঙ্গবন্ধু। প্রসঙ্গত মনে পড়ে, উনিশ শ বায়ান্ন সালের ২৫ জুন হায়দরাবাদে অবস্থানরত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে লাহোর থেকে লেখা শেখ মুজিবুর রহমানের একটি চিঠির এই বাক্যদ্বয় : ‘Please don’t think for me. I have born to suffer.’ বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর এই রাজনৈতিক দর্শন মানবমুক্তির পথে নতুন এক সম্ভাবনার দুয়ার যে মুহূর্তে উন্মোচন করতে যাচ্ছে, সে মুহূর্তেই জাতিক-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনকশায় শহীদ হলেন বঙ্গবন্ধু।
কিন্তু কেন? কারণ একটাই—বাংলাদেশের স্বাধীনতার চাকাকে পরাধীনতার পঙ্কে নিমজ্জিত করা এবং বিশ্বের শোষিত মানুষের মুক্তির অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধুর দর্শনকে স্তব্ধ করে দেওয়া। তাঁর মৃত্যু কেবল বাংলাদেশের জন্যই নয়, বিশ্বের শোষিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামেই এক প্রবল আঘাত—এ কথাই ধ্বনিত হয়েছে ফিদেল কাস্ত্রোর পূর্বোক্ত উক্তিতে। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ বিশ্ব পুঁজিবাদ চায়নি বঙ্গবন্ধুর ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ পরিচয়বাহী রাজনৈতিক দর্শন পূর্ণতার সুযোগ পাক, পৃথিবীর কোনো দেশে তার বাস্তবায়ন ঘটুক। তারা যথার্থই বুঝেছিল, বঙ্গবন্ধুর এই দর্শনের সফল বাস্তবায়ন তাদের শোষণের মহোৎসবে হয়ে দাঁড়াবে প্রবল বাধা। অতএব গভীর ষড়যন্ত্র, নীলনকশা এবং পরিণতিতে পঁচাত্তরের আগস্ট ট্র্যাজেডি।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে ঘাতকচক্র বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করে এ দেশকে আবার পাকিস্তানমুখী করতে চেয়েছিল। পঁচাত্তরের পর দীর্ঘ একুশ বছর ধরে যারাই ক্ষমতায় এসেছে, তারা চিরতরে ধ্বংস করতে চেয়েছে বঙ্গবন্ধুর অনন্য রাজনৈতিক দর্শন, ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছে তাঁর নাম-পরিচয়। কিন্তু সময়ের বিচারে তারাই নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বিদেহী বঙ্গবন্ধু যে কত শক্তিশালী, এ কথা কুচক্রীরা, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা অনুধাবন করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে, অনেকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে, কেউ কেউ তেলাচাটার মতো বিদেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু আছেন প্রধানতম ব্যক্তি হিসেবে। কেবল বাংলাদেশ নয়, সমগ্র বিশ্বেই বঙ্গবন্ধু প্রতিদিন নতুন নতুন মর্যাদায় অভিষিক্ত হচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ আজ ইউনেসকো ঘোষিত অন্যতম ‘বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদ’, বঙ্গবন্ধু থেকে এখন তিনি বিশ্ববন্ধুতে উপনীত, পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু চেয়ার কিংবা বঙ্গবন্ধু কর্নার, অনেক দেশ তাঁর নামে প্রবর্তন করছে শান্তি পুরস্কার। পৃথিবীর মানুষের কাছে বাঙালির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ নতুন মর্যাদায় অভিষিক্ত।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের আলোয় বাংলাদেশ এখন এগিয়ে চলছে সামনের দিকে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বাংলাদেশ এখন ‘মিরাকল অর্থনীতি’র দেশ, পৃথিবীতে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পেয়েছে স্বীকৃতি। বাংলাদেশের এই অগ্রগতি ও উন্নয়ন এসেছে বঙ্গবন্ধুর আত্মজা শেখ হাসিনার দেশ পরিচালনার দক্ষতার মধ্য দিয়ে। শেখ হাসিনা মানেই তো পরোক্ষ বঙ্গবন্ধু—পরোক্ষ বলি কেন প্রত্যক্ষই বঙ্গবন্ধু। সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধু শোষিতের গণতন্ত্রের রাজনৈতিক দর্শনের আলোকে যেসব কাজ করতে আরম্ভ করেছিলেন কিন্তু সম্পূর্ণ করতে পারেননি; এখন সেসব কাজ কিংবা বলি আরো অনেক নতুন কাজ শেখ হাসিনা সম্পূর্ণ করছেন—বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে নির্মাণ করেছেন। অর্থনীতির মতো সামাজিক সব সূচকেও বাংলাদেশের অগ্রগতি রীতিমতো বিস্ময়কর। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, গৃহায়ণ যেকোনো দিকেই বাংলাদেশের অগ্রগতি এখন সহজেই দৃশ্যমান। সামাজিক অনেক সূচকেই বাংলাদেশ এখন প্রতিবেশী অনেক দেশকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারের এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে দুই হাজার একচল্লিশ সালের আগেই বাংলাদেশ উন্নত দেশের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারবে বলে আশা করা যায়।
এত অগ্রগতি সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে আমাদের যেতে হবে আরো বহুদূর। সে যাত্রায় বঙ্গবন্ধুর ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ হতে পারে আমাদের প্রধান শক্তির উৎস। কিন্তু সে ক্ষেত্রেই মাঝে মাঝে দেখা দেয় শঙ্কা। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার দুঃসময়ের ধাক্কা বাংলাদেশেও লেগেছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক একনায়কত্বের স্থানে আমলাতান্ত্রিক একনায়কত্বের প্রাধান্যও দিনে দিনে প্রবল হয়ে উঠছে—যা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের একেবারে বিপ্রতীপ। এ ক্ষেত্রে এখনই সচেতন হওয়া দরকার। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মহাসুযোগ কাজে লাগিয়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের আলোকে এগিয়ে গেলে অচিরেই শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক মানবিক বাংলাদেশ নির্মাণ করতে আমরা সফল হব বলে আশা করতে পারি এবং তা-ই হবে আগস্ট ট্র্যাজেডির যথার্থ ক্যাথারসিস বা পরম বিমোক্ষণ।
সম্পর্কিত খবর

চরিত্রহীন
- রুদ্র অহম

একদিন বিবেকবাবু ডাকলেন
বললেন, শোনো, আর যা-ই করো,
তোমার চরিত্র হারিয়ো না কখনো।
শুনে আমি খানিক বিস্মিত হলাম!
বললাম, বিবেকবাবু,
আপনি তো জানেন,
মদ-জুয়া কিংবা পরকীয়া
আমার কিছুতে আসক্তি নেই।
তাহলে চরিত্র হারাব কিসে?
বিবেকবাবু হাসলেন।
বললেন, কিছু মানুষ আছে, যারা
সারাক্ষণ অন্যকে খুশি করতে,
অন্যের প্রিয়পাত্র হতে মত্ত থাকে।
কারোর অপ্রিয় হওয়ার সাহস নেই,
মাথা তুলে দাঁড়াবার মেরুদণ্ড নেই।
যেমন পানি। যে পাত্রেই রাখো,
তার আকার নেয়; নিজস্বতা নেই।
যার নিজের রুচি-পছন্দ-ইচ্ছে স্বতন্ত্র,
সে কখনো সকলের প্রিয় হয় না।
আর যে সকলের প্রিয়,
তার কোনো চরিত্র নেই।

বর্ষারূপ
- আসাদ কাজল

অভিনব বর্ষা বুকের ভিতর কাঁদে
সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ষার ভিতর চলাচল
বর্ষা বহমান প্রকৃতিতে অবিচল
আমি শুধু পড়ে থাকি স্বপ্নময় ফাঁদে।
প্রকৃতির মেঘ দূরে সরে যায়। তবু
প্রণয়সঙ্গিনী মনের ভিতর একা।
বর্ষাভেজা রাতে সংগোপনে দেয় দেখা
বর্ষায় নিভৃতে ডাকি স্বরচিত প্রভু।
কদমফুলের মতো তোমার দুচোখ
ভালোবেসে উপেক্ষা করেছি রাজ্য-রাজা
চৈত্র ভুলে পুরনো বর্ষায়—যত শোক
ভুলে যাই আমি মনের সমস্ত সাজা।
তবু বর্ষা আসে, উদ্যমে গোপন সঙ্গ
বর্ষারূপ আমার ভিতর স্বপ্নভঙ্গ।

শান্তি
- ফারুক মাহমুদ

তোমার বাগান থেকে তুলে আনা দুটি পাকা বীজ
রোপণ করেছি বারান্দার টবে
অপেক্ষা অপেক্ষা শুধু—কবে হবে গাছ
সেই গাছে দুলে দুলে দুলতে থাকবে
শাখাছন্দ, অহরহ অগণিত সবুজ বাতাস
ফুলের প্রকাশ্য মুখ, থেকে থেকে সুরভিত গান
কোনো এক পুণ্যপ্রাতে দেখি—
বীজ থেকে হতে হতে হয়ে ওঠা গাছে
‘প্রথম ফুটেছে কলি’। মনে হলো তুমি বুঝি এলে
চেনা গন্ধ, চারপাশে প্রবাহিত শান্তিসত্যধারা
।

প্রদর্শনী
আটাশ শিল্পীর নান্দনিকতা
- মোহাম্মদ আসাদ

প্রদর্শনীর মাধ্যমে শিল্পীদের কাজ শিল্পপ্রেমীদের নজরে আসে। বিগত শতাব্দীতে এই গুরুদায়িত্ব শিল্পকলা একাডেমি পালন করত। ছিল কয়েকটি গ্যালারি। সেখানে বিশেষ কিছু শিল্পীই প্রদর্শনীর সুযোগ পেতেন।
এই প্রদর্শনীর শিল্পীরা হলেন আবদুল্লাহ আল বশির, আব্দুস সাত্তার তৌফিক, আল-আখির সরকার, আনজুম সুলায়মান, অনুকূল চন্দ্র মজুমদার, আশফাক বাপ্পী, বিপ্লব চক্রবর্তী, বিশ্বজিৎ গোস্বামী, কে জামান শিমুল, কামাল উদ্দিন, কামরুজ্জোহা, কাজী শহীদ, লুত্ফা মাহমুদা, মো. জিয়াউর রহমান, মনজুর রশিদ, মুনতাসির মঈন, নাঈম জামান, নাজিয়া আহমেদ, প্রদ্যুৎ কুমার দাস, রত্নেশ্বর সূত্রধর, রেজাউর রহমান, রুহুল আমিন তারেক, এস এম সাহা, আনিসুজ্জামান ফারুক, সৌরভ চৌধুরী, সুমন ওয়াহেদ, সৈয়দ গোলাম দস্তগীর, ত্রিবেদী গোপাল চন্দ্র গুপ্ত।
বিশাল এই প্রদর্শনীর কোনো আয়োজক প্রতিষ্ঠান নেই। নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে প্রদর্শনীটির শুরু। তার পরও একজন তো দায়িত্বভার বহন করেছেন।
কোনো বাণিজ্যিক চিন্তা ছাড়া এমন সুন্দর আয়োজনে শিল্পীরা যেমন উৎসাহিত হবেন, শিল্পকলাপ্রেমীরাও একই সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেখতে পারবেন।