একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে সিলভিয়া প্লাথের বিষয়ে আমার আগ্রহের সীমা-পরিসীমা নেই। তাঁর জীবন ও রচনা এতটাই দুর্মর যে কোনো সাহিত্যাস্বাদনকারী মোহগ্রস্ত হবেনই। আমেরিকা থেকে ফুলব্রাইট কমিশন স্কলারশিপ নিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেই সিলভিয়ার সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় কবি টেড হিউজের। সম্পর্কের সূচনাটাও মাদকীয়। সিলভিয়া প্লাথকে লেখা টেড হিউজের একটি চিঠি পাঠে তা অনুমান করা যায়।
(প্রতি, সিলভিয়া প্লাথ, মার্চ ১৯৫৬, ১৮ রাগবি রোড়)
সিলভিয়া,
সেই রাত কিছুই না, আমি অনুভব করলাম কতটুকু মোলায়েম ও আবেদনময়ী ছিল তোমার শরীর। সেই মুহূর্ত আমার মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ ব্র্যান্ডির মতো মাতাল করে রেখেছে। তুমি যদি লন্ডনে না আসো তাহলে আমি তোমার কাছে আসব কেমব্র্রিজে। আমি ১৪ তারিখ পর্যন্ত লন্ডনে আছি। প্যারিস উপভোগ করো। —টেড
লন্ডনের এই বাড়িতেই প্রথম সিলভিয়া প্লাথ ও টেড হিউজের দেখা হয়। এখানেই তাঁদের প্রথম রাত কাটে একসঙ্গে। টেড সেই রাতের পরেই প্লাথের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। এরপর দীর্ঘদিন লন্ডনের ক্যামডেন কাউন্সিল এলাকার প্রিমরোজ হিলের সেলকট স্কয়ারের বাড়িতেও তাঁরা একসঙ্গে বসবাস করেন অনেক দিন। তবে তাঁদের সবচেয়ে আলোচিত হলো প্রিমরোজ হিলের ফিটজরয় রোডের বাড়ি, যে বাড়িতে আত্মহত্যা করেছিলেন সিলভিয়া প্লাথ। বাড়িটি এখনো সে রকমই আছে।
ওই যে সম্পর্কেও সূচনা হলো, সেই সম্পর্ক ১৯৫৬ সালের ১৬ জুন রূপ নেয় প্রণয়ে। দুজন শুরু করেন সংসার। বিয়ের পর আমেরিকার বোস্টন শহরেই বসবাস শুরু করেন। পরে আবাস গড়েন লন্ডনে। সিলভিয়া প্লাথ তাঁর মেধায় প্রতিটি স্তর উতরে এলেও একেবারে নিজস্ব মনোদৈহিক সংকটে সব সময় ছিলেন ঝুঁকিতে। কলেজজীবনের শেষদিকে ‘নার্ভাস ব্রেকডাউন’-এ আক্রান্তের কারণে চিন্তায় সব সময়ই কাজ করত আত্মহত্যা। জীবনের বিভিন্ন সময়ে তিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছেন। এই সংকটঘন প্রবণতাই বিধৃত হয়েছে তাঁর একমাত্র উপন্যাস ‘দ্য বেল জার’ (১৯৬৩)-এ। আর এই উপন্যাসের যুক্তরাজ্য প্রকাশনের এক মাস পরই আত্মহত্যা করেন সিলভিয়া প্লাথ।
মৃত্যুর পাঁচ বছর আগে থেকে দুজনের দূরত্বে বসবাস, টেড হিউজের অন্য নারীর দিকে ঝুঁকে যাওয়া—এসবই আত্মহত্যার কারণ। প্রচণ্ড অভিমানী আমেরিকান-ব্রিটিশ এই কবি জীবনের বিভিন্ন সময়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছেন। ১৯৬৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি গ্যাস চেম্বারে মাথা সেঁধিয়ে আত্মহত্যা আসলেই কি করতে চেয়েছিলেন তিনি? তিনি অপেক্ষায় ছিলেন হিউজ ফিরে আসবেন। সেই ফিরে না আসার অভিমান তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল মৃত্যু অগ্নিকুণ্ডে। আত্মহত্যার আগে সিলভিয়া প্লাথ টেড হিউজকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন ডাকে। তাতে একটি লাইন ছিল, ‘এটি তোমাকে লেখা আমার শেষ চিঠি। তুমি ফিরে এসে আমাকে আর পাবে না।’
শেষদিকে দুজনের দূরত্ব চোখে পড়ে কয়েকটি চিঠি পাঠে। প্রায় একই সময়ে লেখা সিলভিয়া প্লাথের চিঠিতে এ-বিষয়ক সংকেত বেজে ওঠে। এখানে দুটি চিঠি উল্লেখ করলাম বন্ধু ও তাঁর মাকে লেখা।
প্রতি, রুথ ফেইনলাইট (বুধবার, ২৬ ডিসেম্বর ১৯৬২, ২৩ ফিটজরয় রোড, লন্ডন এনডাব্লিউ ১)
প্রিয় রুথ
তোমার ফ্ল্যাট সম্পর্কে চিঠিটি আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। এখন রাত। আমি সবেমাত্র ফিরে এসেছি কোর্ট গ্রিন থেকে ইয়েটস হাউসের জন্য পাঁচ বছরের চুক্তি সই করে। এখন আমি প্রথম তলার বারান্দায় বসে আছি আমার দুই বাচ্চাকে নিয়ে। তাদের দুজনের প্রচণ্ড সর্দি। দেখছি আঠারো শতকের মতো বুনো তুষারপাত। আমি ফেব্রুয়ারিতে তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায় আছি! আমার পরিকল্পনা শরৎ ও গ্রীষ্মে কোর্ট গ্রিনে ফিরে আসা। তুমি চেষ্টা করো, এক সপ্তাহের মতো ফার্নিচারের কাজ করে এই বাড়িটি আমেরিকান কোনো ভাড়াটিয়ার কাছে ভাড়া দিয়ে দিতে পারো কি না। এর মাধ্যমে আমাকে ঋণ শোধ করতে হবে। দয়া করে তুমি আমার সঙ্গে ডেভনের বাড়িতে আসো! কওলি গ্রামের সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমার স্বামী কোথায়? আমার সঙ্গে ছিল, নাকি ছিল না? নাকি এই বিশাল বাড়িতে আমি একা থাকি?
আমি প্রায় প্রতিদিনই রিজেন্ট পার্ক ও প্রিমরোজ হিলে আমার সন্তানদের নিয়ে বের হই। পান করি পুরনো জায়গায়। ওই স্থানগুলো আমার খুবই প্রিয়। টেড চলে যাওয়ার পর থেকে ফ্রেইদা অস্বাভাবিক আচরণ করছে। সে ছিল টেডের খুব প্রিয়। সে দিন দিন অশুভ আচরণ করতে শুরু করেছে। এই আচরণ যে বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছবে না তা কে বলতে পারে। সে আমার কাছেও থাকতে চায়, আবার অস্বাভাবিক আচরণ করে। অনেক ভালোবাসা এবং তোমার ফিরে আসার জন্য অধীর আগ্রহে আছি। —সিলভিয়া
এই চিঠির কয়েক দিন পরই মা অওরালিয়া প্লাথকে লেখা চিঠিতে টেডের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কোথায় রয়েছে তা স্পষ্ট হলো।
প্রতি, অওরালিয়া সোবার প্লাথ
(বুধবার, ২ জানুয়ারি ১৯৬৩)
প্রিয় মা,
আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে তুমি ঠিকঠাকমতো ছবিগুলো পেয়েছ। আমি চমৎকার একটি চিঠি পেয়েছি মার্টির কাছ থেকে। আমি জেনে পুলকিত, সে ও মাইক এই শরতের শুরুতে আসবে এখানে। আর আমাদের ভালোর জন্যই তুমি সবাইকে বলো যে আমি ও টেড আলাদা হয়ে গেছি। তুমি যদি এতে ভালো অনুভব করো, আমি তাঁকে ডিভোর্স দিতে পারি! আমার বাচ্চা আর আমি ক্রিসমাসে অত্যন্ত বাজে ঠাণ্ডায় আক্রান্ত হয়েছি। এখন ভালো আছি। এটি আমার জন্য অত্যন্ত প্রশান্তির যে আমি ফেরত এসেছি আগের চিকিৎসক হডারের কাছে। এই চিকিৎসক চমৎকার এবং আমাকে বুঝতে পারে ভালো। আমাকে সুস্থ করেই সে নিকের চোখের চিকিৎসা শুরু করবে। এবার তোমাকে অন্য কথা বলি, যে বিষয়ে তুমিও আমাকে সহায়তা করতে পারবে। আমি বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটি বিজ্ঞাপন পাঠাতে চাই দ্বিতল বাসাভাড়ার বিষয়ে। আমি মনে করি, এটি সবচেয়ে সহজ উপায় এ বছর আমার বাড়িভাড়া আগে পরিশোধ করার। এর জন্য প্রচুর চাপ রয়েছে আমার ওপর। আমি একটি বিজ্ঞাপন তৈরি করে তোমাকে পাঠাব। ধন্যবাদ—সিলভি।
ওপরের চিঠিতে শুধু সম্পর্ক ছেদের কথাই নয়, সিলভিয়া প্লাথের আর্থিক কষ্টের মুহূর্তও ধরা রয়েছে। এ রকম আরো অনেক চিঠিতে তিনি মা ও বন্ধুদের আর্থিক কষ্টের কথা বলেছেন। টেড হিউজ যখন একসঙ্গে থাকা বন্ধ করে দিলেন, তখন সিলভিয়া চরম আর্থিক কষ্টে পতিত হলেন।
মন্তব্য