কানের ৭৫তম আসরের লালগালিচায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সমালোচক বিধান রিবেরু (সবার বামে), সঙ্গে সহবিচারকরা
বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র সমালোচক আপনি, যিনি কানের লালগালিচায় হাঁটলেন...
জি। তবে আমার আগে আহমেদ মুজতবা জামাল এসেছিলেন। আগে লালগালিচায় মূল প্রতিযোগিতার জুরিরাই হাঁটতে পারতেন, এবার প্রথমবার প্যারালাল বিভাগের জুরিরাও হাঁটার সুযোগ পেয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
‘সিনেমা দর্শন’ নামে একটা পত্রিকা বের করেন, সিনেমাবিষয়ক বইও আছে আপনার। আবার ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবেও বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন। কান আপনাকে সমালোচক হিসেবে মূল্যায়ন করেছে কোন জায়গা থেকে?
ওভারঅল মূল্যায়ন করেছে। আমি ফিপ্রেসির সদস্য। এখানকার সদস্য হতে গেলে একটা লম্বা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। চলচ্চিত্রবিষয়ক অনেক লেখা পাঠাতে হয়। ফিপ্রেসির প্রধান কার্যালয় কিন্তু জার্মানিতে। সাধারণত অল্প সময়ের মধ্যে দুটি উৎসবে কাউকে জুরি করা হয় না। জানুয়ারিতে আমি ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভালের ফিপ্রেসি জুরি ছিলাম, মে মাসে ডাক পেলাম কানে। মাঝখানে ঢাকা ফেস্টিভাল নিয়ে বেশ কয়েকটি রিপোর্ট পাঠিয়েছিলাম, সম্ভবত এ কারণেই ওরা আমার ওপর সন্তুষ্ট।
কল্পনায় কান উৎসব সম্পর্কে যে ধারণাটা ছিল আপনার, বাস্তবের সঙ্গে তার কতটা মিল খুঁজে পেলেন?
খুব একটা পার্থক্য পাইনি। আমি তো আগে থেকে খোঁজখবর রাখতাম। কানের পার্ট হতে পারব, এটা কখনো ভাবিনি। তবে ফিল্ম নিয়ে যেহেতু কাজ করছি, চেষ্টা ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার। তিন বছর আগে পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন করতে গিয়েছিলাম, অ্যাপ্রিসিয়েশন শিখতে নয়, গিয়েছিলাম ওখানকার ফিল্ম বুঝতে এবং বোদ্ধাদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে। সেখান থেকে ফিরে একটা বই লিখেছি, নাম ‘সিনেমা সফর’। বিশ্বের ফিল্মি বোদ্ধাদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে আমি আসলে নিজের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাই। কানে এসে বুঝলাম, বিশ্বের অন্য চলচ্চিত্র সমালোচকদের তুলনায় আমরা বাংলাদেশিরা খুব বেশি পিছিয়ে নেই।
কানে আপনার সহবিচারকদের সম্পর্কে বলুন। তাঁদের মধ্য থেকে কার সঙ্গে আপনার ভালো জমেছে?
প্যারালাল বিভাগে আমার সহবিচারক ম্যাগালি রিথ, ও ফরাসি সমালোচক। তাঁর সঙ্গে নিয়মিত মিটিং করতে হয়, একসঙ্গে ছবি দেখি, আলাদাও দেখি। পরে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করি। এখানে ছবি দেখে মজা আছে, কারণ ছবির কারিগরি দিক নিয়ে কথা বলতে হয় না। সব ছবিই টেকনিক্যালি ‘ওকে’। বাংলাদেশের ছবি নিয়ে বলতে গেলে প্রথমে বলা লাগে, লাইটটা ঠিক হয়নি, মেকআপ ঠিক হয়নি। এখানে বলতে হয় কনটেন্ট ও তার ন্যারেশন নিয়ে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন কালচারের ছবি আসে, ওখানকার মিথ সম্পর্কে না জানলে ছবির বিচার করা কঠিন। এগুলো নিয়েই আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করি। আমরা সাতজন শুরু থেকে বিচারকার্য করছি, আজকে (সোমবার) একজন যোগ দিয়েছেন। আমি আর ম্যাগালি ছাড়াও আছেন মিসরের আহমেদ শোকি, ইতালির সিমন সরানা, ফ্রান্সের নাতালি শিফলে, পোল্যান্ডের মারিওলা উইকটর, মরক্কোর জিহান বুগরিন ও নাইজারের একজন। মোট ৪০টা ছবি দেখব আমরা, ২৫টা দেখে ফেলেছি।
ছবি দেখার অভিজ্ঞতা কেমন?
অভিজ্ঞতা বেশ মজার। স্বর্ণপামের লড়াইয়ে যে ছবিগুলো থাকে তার বেশির ভাগই চলতি ন্যারেটিভ, মানে বাজার চিন্তা করে চূড়ান্ত করা হয়। প্যারালাল সেকশনে এক্সপেরিমেন্টাল অদ্ভুত ধরনের সব ছবি, ম্যাজিকাল রিয়ালিজমের অনেক কাজ দেখা যায়। এ কারণে এখানে ছবি দেখাটা বেশ আনন্দের।
কানের ফিল্মবাজার মার্শে দ্যু ফিল্মে বাংলাদেশ থেকে অনেকেই যান, আবার গত বছর প্রথমবার বাংলাদেশের কোনো ছবি (রেহানা মরিয়ম নূর) ‘আঁ সার্তে রিগা’য় অফিশিয়ালি নির্বাচিত হয়ে প্রতিযোগিতা করল। দুটার মধ্যে বিশাল পার্থক্য। সাধারণ পাঠকদের জন্য যদি বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলেন...
একটা উদাহরণ দিই। ধরুন, বাংলা একাডেমির বইমেলার মূল মঞ্চে প্রতিদিন সেমিনার হয়, সেখানে যাঁরা আমন্ত্রিত হন তাঁদের এক ধরনের সম্মান জানায় বাংলা একাডেমি। পাশাপাশি মেলায় বিভিন্ন প্রকাশনীর স্টল থাকে। সেখানকার কোনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান যদি তাদের স্টলে কোনো অতিথি ডেকে বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করে, তিনি কিন্তু বাংলা একাডেমির অতিথি নন। কান চলচ্চিত্র উৎসবের এক আফ্রিকান স্টলে বাংলাদেশের একজন নায়ক-প্রযোজক অর্থ খরচ করে নিজের ছবির ট্রেলার দেখিয়েছেন। এভাবে যে কেউই সেখানে নিজের পণ্য (ছবি) নিয়ে হাজির হতে পারেন। এ জন্য আপনাকে নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করতে হবে।
কানে বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হাছান মাহ্মুদ বলেছেন, সামনের বছর থেকে কানে বাংলাদেশের স্টল থাকবে...
আমি তখন সেখানেই ছিলাম। আমি এফডিসির এমডিকে বলেছি, এখানে স্টল হলে বাংলাদেশিরা এসে বসতে পারবেন, চা-বিস্কুট খেতে পারবেন। কিন্তু স্টলে কনটেন্ট কী রাখবেন? আগে কনটেন্টে নজর দিতে হবে, পরে না হয় স্টল দেওয়া যাবে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বায়োপিক ‘মুজিব—দ্য মেকিং অব আ নেশন’-এর ট্রেলার দেখানো হলো কানে। সংশ্লিষ্টরা সেখান থেকে বলছেন, বেশ প্রশংসিত হয়েছে, সাড়া ফেলেছে ট্রেলারটা। আপনি তো সেখানে ছিলেন, এই প্রশংসার মাত্রাটা কেমন ছিল?
কোথায়? আমার তেমন কিছু চোখে পড়েনি। ট্রেলারটা দেখানো হয়েছে মার্শে দ্যু ফিল্মের ভারতীয় প্যাভিলিয়নে। কোন প্যাভিলিয়নে কী হলো সেটার খোঁজ রাখেন না মূল উৎসবের কেউই। আর সাড়া ফেললে অবশ্যই চোখে পড়ত। এখান থেকে প্রতিদিন তিনটা ইংরেজি বুলেটিন প্রকাশিত হয়—ভ্যারাইটি, দ্য হলিউড রিপোর্টার ও স্ক্রিন। ফরাসি ভাষার বুলেটিন তো আছেই। প্রতিদিনের বুলেটিনগুলো সংগ্রহ করি, কোথাও এই ছবির ট্রেলার প্রকাশের খবর পাইনি। আবার বড় কোনো সংস্থা ছবিটি পরিবেশনার জন্য নিয়েছে বলেও শুনিনি।