<p>দেশে কয়েক বছর ধরে চিংড়ির উৎপাদন ও রপ্তানি দুই-ই ধারাবাহিকভাবে কমে চলেছে। এর জন্য বিদেশি বাজারে কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পাওয়াকে দায়ী করা হচ্ছে। প্রধানত : ইউরোপের বাজারে বাগদা চিংড়ির দাম কমে যাওয়ায় এই সংকট দেখা দিয়েছে।</p> <p>বিদেশি বাজারের সুযোগ থাকায় গত শতকের আশির দশকে এই পণ্যটির ব্যাপক চাষ শুরু হয়। এত দিন যেসব জমিতে নোনা পানির চিংড়ি চাষ হয়েছে, সেখানে এখন অন্য কোনো ফসলও হচ্ছে না; অথচ চিংড়ি উৎপাদন করে তাতে উৎপাদন খরচও উঠছে না। অবশ্য বিদেশি বাজারে এবারে বাগদা চিংড়ির চাহিদা ভালো, দামও মিলছে, কিন্তু এবারে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন নেই।</p> <p>চিংড়ি চাষি ও রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েক বছর ধরেই চিংড়ি উৎপাদন ও রপ্তানি ক্রমাগতভাবে কমছিল। এ দেশে মাত্র দুই ধরনের চিংড়ি—নোনা পানির বাগদা ও মিষ্টি পানির গলদা চাষ হয়। প্রায় তিন লাখ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হয়। তার দুই লাখ হেক্টর জমিতে বাগদা ও বাকি জমিতে গলদার চাষ হয়। বাগদা চাষ শুরু হয় ফেব্রুয়ারি-মার্চ থেকে, ফলন পাওয়া যায় জুলাই-আগস্ট মাসে। গলদার চাষ শুরু হয় আগস্ট-সেপ্টেম্বরে, ফলন পাওয়া যায় ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এবার করোনা মহামারির কারণে বাগদা মৌসুমে পোনা না পাওয়া, চলাচলের অসুবিধা এবং ধারাবাহিকভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমায় উৎপাদকরা লোকসানের মুখে উৎপাদনে অনীহা দেখান। এ কারণে বাগদার চাষ হয়েছে কম এলাকায়। সাধারণভাবে যে পরিমাণ জমিতে চিংড়ি চাষ হয়, চলতি মৌসুমে তার অর্ধেক জমিতেও চিংড়ি চাষ হয়নি। চাষ কমে গেলে উৎপাদন স্বাভাবিকভাবেই কমবে। অবশ্য, মৎস্য অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় অফিস সূত্রে জানা যায়, খুলনা বিভাগের ১০ জেলার চার জেলায় বাগদা চিংড়ির চাষ হয়। এর মধ্যে খুলনায় ৩২ হাজার ৮৯৬ দশমিক ২ হেক্টর জমিতে ২০ হাজার ৪৩০টি ছোট-বড় বাগদা চিংড়ি ঘের; সাতক্ষীরায় ৬৬ হাজার ৮৩২ হেক্টর জমিতে ৫৪ হাজার ৯৩২টি ঘের; বাগেরহাটে ৫১ হাজার ৮৮০ হেক্টর জমিতে ৩৫ হাজার ৬৮২টি ও যশোরের ৭৫৮ হেক্টর জমিতে ৮৯৩টি ঘের রয়েছে।</p> <p>জানা যায়, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতির কারণে ২০০৭ সাল থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির দাম কমতে থাকে। কম দামের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে ভেনামি চিংড়ির চাহিদা বাড়ে। দাম কমতে কমতে বাগদা চিংড়ি পাউন্ডপ্রতি তিন থেকে সাড়ে তিন ডলারেও বিক্রি হয়েছে। দাম কমায় রপ্তানিও কমে। ২০১৯ সালে চিংড়ি রপ্তানি করে মোট আয় হয় ৩৬৫ মিলিয়ন ডলার। অথচ ২০১২ সালে এই খাতে আয় হয় ৫৯০ মিলিয়ন ডলার। রপ্তানি পণ্য তালিকার দুই নম্বর থেকে চিংড়ি পাঁচে নেমে এসেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ হিসাব বছরে বাংলাদেশ মোট ৫৪৫ মিলিয়ন ডলারের ৪১ হাজার ২৩৬ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি করে।</p> <p>এর পর থেকেই বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে চিংড়ির বাজার হারাতে থাকে। সেই সঙ্গে উৎপাদনও ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে চিংড়ি রপ্তানি ৩৪ শতাংশ কমে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হয়েছে ৩৬১ মিলিয়ন ডলার। রপ্তানি হয়েছিল ২৯ হাজার ৫৪৩ মেট্রিক টন চিংড়ি।</p> <p>বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি চিংড়ি রপ্তানি হয়। যুক্তরাজ্য চিংড়ির অনেক বড় বাজার। এ ছাড়া আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া এবং জাপানেও চিংড়ি রপ্তানি হয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএওর মতে, বিশ্ববাজারে চিংড়ির চাহিদা বাড়ছে। ২০১৪ সালে ৪৩ লাখ মেট্রিক টন চিংড়ির চাহিদা ছিল। ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত চিংড়ির চাহিদা বেড়ে হয়েছে ৪৮ লাখ মেট্রিক টন।</p> <p>বিদেশি বাজারে দাম কমে যাওয়ায় দেশে উৎপাদনকারীরা অব্যাহতভাবে লোকসানের মুখে পড়েন। এ কারণে উৎপাদক পর‌্যায়ে চিংড়ি চাষে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। এর সঙ্গে এবারে করোনা মহামারি যুক্ত হওয়ায় উৎপাদকরা আরো পিছু হটেন। অবশ্য এবারে বিদেশের বাজারে বিশেষত : যুক্তরাজ্যে বাগদার চাহিদা ও দাম দুই-ই বেড়েছে। বাগদা এখন পাউন্ডপ্রতি ছয়-সাত ডলার, এমনকি আট ডলারেও বিক্রি হচ্ছে। করোনার শুরুতে অনেক ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছিল, কারখানায় প্রক্রিয়াজাত চিংড়ির মজুদ বেড়েছিল। তবে জুন-জুলাই মাসে চিংড়ি রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় ১০ ভাগেরও বেশি বেড়েছে। এতে রপ্তানিকারকরা লাভবান হলেও উৎপাদকরা তাঁদের ক্ষতি পোষাতে পারছেন না। চাষ পর‌্যায়ে এক ধরনের অনীহার কারণে এবার বাগদার উৎপাদন কম; গলদা আগেভাগেই উঠতে শুরু করেছে, তবুও চাহিদা অনুযায়ী রপ্তানি করার মতো চিংড়ি পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। রপ্তানি পণ্য হিসেবে চিংড়ি বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রক্রিয়াকরণ কারখানাও বাড়ে। দেশে ১৮০টির মতো প্রক্রিয়াকরণ কারখানা গড়ে উঠেছিল। এখন তা বন্ধ হতে হতে ৬০টিতে এসে ঠেকেছে। শুধু খুলনায় প্রক্রিয়াকরণ কারখানা ছিল ৫৯টি; যার মধ্যে চালু আছে মাত্র ২৩টি।</p> <p>চিংড়িশিল্পকে বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন—বিএফএফইএ সরকারের কাছে কয়েকটি প্রস্তাবনা তুলে ধরেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রপ্তানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা বাড়িয়ে ১৫ শতাংশে উন্নীত করা; কারখানা মালিকদের ভ্যাট ও বিদ্যুৎ খরচ আরো কমিয়ে আনা এবং মোট দেওয়া ভ্যাট থেকে ১০ শতাংশ ফেরতের বিষয়টি কার্যকর করা; উৎপাদক পর‌্যায়ে স্বল্প সুদে ঋণ দান ও পণ্যটি ইনস্যুরেন্স সুবিধার আওতায় আনা প্রভৃতি।</p> <p>জানতে চাইলে বিএফএফইএর সাবেক পরিচালক ও আমাম সি ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘চার দশকের বেশি বয়সী এই খাত এখন বেশ নড়বড়ে। উৎপাদনের দিক দিয়ে আমরা এখনো সেকেলে। আমরা এখনো মোট উৎপাদিত চিংড়ি চাষের জমির ১ শতাংশও সেমি-ইনটেনসিভ বা ইনটেনসিভ পর‌্যায়ে উন্নীত করতে পারিনি। দীর্ঘদিন থেকে ভেনামি চাষের অনুমতি চাইলেও পাওয়া যায়নি। অবশ্য, এখন অনুমতি মিলেছে। পরীক্ষামূলক উৎপাদন সফল হলে আমরা আবারও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় ফিরতে পারব বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তবে স্মরণ করিয়ে দেন যে এই শিল্পটিকে রক্ষা করতে হলে সরকারের সহায়তার কোনো বিকল্প নেই।’</p>