<p>রাজশাহীর আড়ানী পৌরসভার আলোচিত মেয়র মুক্তার আলীকে অবশেষে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পাবনার ঈশ্বরদী থানার পাকশী থেকে গতকাল শুক্রবার ভোরে অভিযান চালিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় মুক্তারের ত্রাসের রাজত্ব। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানী পৌরসভার মেয়র মুক্তার আলী একসময় যুবদলের রাজনীতি করতেন। ছিলেন আড়ানী ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি। ১৯৯৮ সালের দিকে তিনি আড়ানী পৌরসভার সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান মিনুর হাত ধরে যুবলীগে যোগ দেন। এর কিছুদিন পরেই তিনি আড়ানী ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি হন। তবে এই দুটি পদ পাওয়ার আগে মুক্তার আলী পুলিশের দালাল হিসেবে রাস্তায় গরুর গাড়ি থেকে চাঁদা ওঠাতেন। এরপর দলীয় দুটি পদ পেয়ে তিনি নানাভাবে চাঁদাবাজি করতে থাকেন। সেই থেকে এখনো ধরে রেখেছেন চাঁদাবাজি ও মাদক কারবার।</p> <p>মেয়র মুক্তার আলী নানা কায়দায় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করতেন। চাঁদাবাজি আর মাদক কারবারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন তিনি। আর সেই টাকার দাপটে এলাকার সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দলীয় নেতাকর্মীদের, এমনকি কলেজ শিক্ষকদেরও ধরে ধরে পিটিয়েছেন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে তাঁর মারধরের শিকার হন দুই পল্লী চিকিৎসক। অভিযোগ পেয়ে পুলিশ গত বুধবার ভোরে তাঁর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে চারটি আগ্নেয়াস্ত্র, মাদক এবং নগদ প্রায় কোটি টাকা জব্দ করে। ওই সময় গ্রেপ্তার করা হয় মুক্তারের স্ত্রীসহ তিনজনকে। তবে অভিযানের আগেই পালিয়ে যান মুক্তার আলী। এর পর থেকেই পুলিশ তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।</p> <p>পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার মুক্তারের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও টাকা উদ্ধারের ঘটনায় তিনটি মামলা হয়। এর আগে তাঁর বিরুদ্ধে আরো পাঁচটি মামলা ছিল। মারধর, বোমার বিস্ফোরণ, লুটপাট, ভাঙচুরসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলাগুলো হয়েছিল। এই মুক্তার নির্বাচনী হলফনামায় নিজেকে এসএসসি পাস দাবি করলেও তিনি সনদ দাখিল করতে পারেননি। গত দুইবারের মেয়র নির্বাচনে তিনি এসএসসি পাসের সনদ হারিয়ে গেছে বলে জিডি করে সেই কপি দাখিল করেছেন। তবে এলাকাবাসী দাবি করে, মুক্তার এসএসসি পাস করেননি। তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরাও তেমন শিক্ষিত নয়। এমনকি মুক্তার পৈতৃক সূত্রেও তেমন কোনো সম্পদ পাননি। দলীয় পরিচয়ে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জমি দখল, মার্কেট দখল এবং মাদক কারবারের মাধ্যমে মূলত কোটি কোটি টাকা বানিয়েছেন। সেই টাকা দিয়ে তিনি আড়ানী বাজারের পাশেই পিয়াদাপাড়া গ্রামে আলিশান দোতলা বাড়ি করেছেন।</p> <p>মুক্তারের একমাত্র ছেলে রাজু আহমেদ গত বুধবারের ঘটনায় পলাতক রয়েছেন। তবে বছর তিনেক আগে চারঘাটে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন রাজু। তাঁর রয়েছে তিনটি মোটরসাইকেল ও একটি প্রাইভেট কার। এসবই ব্যবহার করা হয় মাদক কারবারে। রাজুর ঘর থেকে বুধবার ভোরেও মাদকদ্রব্য উদ্ধার করে পুলিশ।</p> <p>আড়ানীতে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নামে পরিণত হয় মুক্তার বাহিনী। এই বাহিনীর প্রধান হলেন মুক্তার নিজেই। তাঁর প্রধান চার সহযোগী হলেন অঙ্কুর হোসেন, আশিক হোসেন, রাজন ইসলাম ও মিলন। তাঁদের নামেও রয়েছে একাধিক মামলা। তাঁরা আড়ানীতে জমি দখল থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, লুটপাট, সাধারণ মানুষকে মারধর করাসহ নানা অপকর্মে জড়িত।</p> <p>মুক্তার সর্বশেষ গত ১৫ জানুয়ারি পৌরসভার নির্বাচনে মেয়র পদে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েই নৌকা প্রার্থীকে পরাজিত করেন। নির্বাচনের আগেই আড়ানী পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক পদ থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। এর আগে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে আড়ানী ইউনিয়ন যুবলীগের পদ থেকেও তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। আড়ানী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা ও প্রয়াত মেয়র মিজানুর রহমানের মৃত্যুর পর এই মুক্তার তাঁর একটি মার্কেট জোর করে তালা মেরে রেখেছেন। মুক্তার ও তাঁর বাহিনীর ভয়ে মিজানুর রহমানের পরিবারের লোকজন মার্কেটটি খুলতে পারছে না। ফলে আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির মুখে রয়েছে সাবেক মেয়র মিজানুরের পরিবার। মাস দেড়েক আগে মেয়র মুক্তার আলী পৌর কর্মচারী লিটনকে মেরে তিনটি দাঁত ভেঙে দেন। পুরো আড়ানীতে চাঁদার হাট বসিয়েছেন এই মুক্তার আলী ও তাঁর বাহিনীর সদস্যরা।</p> <p>জানতে চাইলে আড়ানী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহিদুজ্জামান শাহিদ বলেন, ‘এলাকায় তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। প্রশাসন সেগুলো তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে। আমরা এসব নিয়ে নতুন করে আর কিছু বলতে চাই না।’</p> <p>রাজশাহীর পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন জানান, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে রাজশাহী জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার একটি দল অভিযান চালিয়ে পাবনার ঈশ্বরদী থানার পাকশী থেকে গতকাল ভোরে মুক্তারকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাঁকে নিয়ে বাঘা থানার আড়ানীর নিজ বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে মাদকদ্রব্য, দেশীয় অস্ত্র ও নগদ এক লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। এর আগে গত বুধবার তাঁর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে চারটি আগ্নেয়াস্ত্র, বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ, মাদকদ্রব্যসহ নগদ প্রায় এক কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়। তখন মেয়রের স্ত্রী ও তাঁর দুই ভাতিজাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।</p> <p><img alt="" src="http://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/ckfinder/innerfiles/images/Print Version Online/print /2021/July/10-07-2021/kalerkantho-pr-1a.jpg" /></p>