ময়মনসিংহের ভালুকায় বীর মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই তালিকায় বাহিনীপ্রধান ও সাবসেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) আফছার উদ্দিন আহম্মেদের নাম এসেছে। এই কারণে ‘আফছার বাহিনী’র বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে।
স্থানীয় সূত্র থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী চারটি অনিয়মিত বাহিনীর মধ্যে ‘আফছার বাহিনী’ অন্যতম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ভালুকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া আফছার উদ্দিন আহম্মেদ। রাজৈ গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী মো. আবদুল হামিদ মিঞার কাছ থেকে ৩১ রাউন্ড গুলিসহ একটি রাইফেল সংগ্রহ করে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সাতজনকে নিয়ে মল্লিকবাড়ী গ্রামে ‘আফছার উদ্দিন ব্যাটালিয়ন’ গঠন করা হয়। একপর্যায়ে এটি আফছার বাহিনী নামে খ্যাতি পায়। স্থানীয় ছাত্র-জনতা, আনসার-পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গড়ে ওঠে এই বাহিনী। তারা ভালুকা, ত্রিশাল, ফুলবাড়িয়া, গফরগাঁও, মুক্তাগাছা, শ্রীপুর, কাপাসিয়া, জয়দেবপুর, মির্জাপুর, কালিয়াকৈর, সখীপুরসহ আশপাশের বেশ কিছু এলাকা মুক্তাঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলে। এই বাহিনী ঢাকা উত্তর ও ময়মনসিংহ দক্ষিণ রণাঙ্গনে ১৫০টি যুদ্ধে অংশ নেয়। এর মধ্যে বাহিনীপ্রধান আফছার উদ্দিন আহম্মেদ ৭৫টি যুদ্ধে অংশ নেন। এ ছাড়া আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা ও যুদ্ধকালে ‘জাগ্রত বাংলা’ পত্রিকা প্রকাশ করা হতো। যুদ্ধে কর্মদক্ষতা ও সাফল্যের জন্য মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সানসিং বাবাজি ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আফছার উদ্দিনকে মেজর উপাধিতে ভূষিত করেন। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিল পত্রে’র নবম খণ্ডের বেশ কিছু অংশজুড়ে স্থান করে নিয়েছে ‘আফছার বাহিনী’র বিরত্বগাথা।
একাধিক মুক্তিযোদ্ধা জানান, ওয়েবসাইটে প্রকাশিত যাচাই-বাছাই তালিকার ভালুকা অংশে মৃত মেজর আফছার উদ্দিন, পিতা মৃত কেরামত আলী নামটিও রয়েছে। এটা জানাজানি হওয়ার পর ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যসচিব জাকির হোসেন শিবলী এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার হক সজিব জানান, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের জন্য বিষয়টি অপমানজনক।
বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা খান ফেসবুকে লেখেন, ‘দুঃখ রাখার জায়গা নাই। ৫০ বছর আগে যাঁর নেতৃত্বে যুদ্ধ করলাম, তাঁর নামও যাচাই-বাছাই তালিকায়?’
‘আফছার বাহিনী’র কম্পানি কমান্ডার চান মিয়া বলেন, ‘ভালুকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যেকের কাছে এম এ জি ওসমানী ও আফছার উদ্দিন আহম্মেদ স্বাক্ষরিত মুক্তিযোদ্ধা সনদ ছিল। তাঁর স্বাক্ষরিত সনদে জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীতে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার চাকরি হয়েছিল।’
আফছার বাহিনীর কম্পানি কমান্ডার অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি মানহানিকর। ওনার ছেলে মরহুম খলিলুর রহমান কম্পানি কমান্ডার ছিলেন। তাঁর নামও এসেছে তালিকায়।’
ময়মনসিংহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবদুর রব বলেন, ‘যাচাই-বাছাইয়ে আফছার উদ্দিন ও আরেক বাহিনীপ্রধান হেমায়েতের নাম আসা আমাদের জন্য লজ্জাজনক।’
আফছার উদ্দিন আহম্মেদের ছেলে স্থানীয় সংসদ সদস্য কাজিম উদ্দিন আহমেদ ধনু বলেন, ‘আমার মা-বাবা, ভাই-ভগ্নিপতিসহ পরিবারে ১৮ জন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধে আমার এক ভাই শহীদ হয়েছেন। বাবার নাম যাচাই-বাছাই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়টি পরিবারের জন্য লজ্জাজনক।’
ভালুকা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা খাতুন বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের তালিকা এখনো হাতে আসেনি। তবে লাল মুক্তিবার্তা ও ভারতীয় তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাইয়ের আওতার বাইরে রাখার নির্দেশনা রয়েছে।’
মন্তব্য