<p>ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারটি যেন অত্যাচার, অনাচার, অনিয়ম আর দুর্নীতিতে ঠাসা। যার ভুক্তভোগী কারাবন্দিরা। তদন্তে প্রমাণ মেলে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আদেশও আসে। তবে সেই আদেশ কার্যকর হয় না। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত হিসেবে যাঁর নামটি প্রথমেই আসে, তিনি কারা সুপার মো. নুরুন্নবী ভূঁইয়া।</p> <p>সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে কারাগারের অনিয়ম-দুর্নীতিতে মো. নুরুন্নবী ভূঁইয়ার সরাসরি যোগসাজশ থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর অধীন ২৭ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। প্রধান কারারক্ষী মো. আব্দুল ওয়াহেদকে বরখাস্ত করা হয়। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর মুন্সীগঞ্জ কারাগারে বদলির অর্ডার হলেও খুঁটির জোর থাকা নুরুন্নবীর এখানেই থেকে যেতে সমস্যা হচ্ছে না।</p> <p>সূত্র মতে, কারাগারসংশ্লিষ্ট দপ্তরে বড় পদে চাকরি করেন নুরুন্নবীর মেয়ের শ্বশুর। বছরখানেক আগে বিয়েতে মেয়েকে দামি গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন তিনি। এরই মধ্যে অঢেল টাকার মালিক বনে যাওয়া জেল সুপার নুরুন্নবী এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। নোয়াখালীর সেনবাগে নুরুন্নবীর দোতলা বাড়ি রয়েছে। লাকসামে শ্বশুরবাড়ি এলাকার উত্তর বাজারে রয়েছে চার তলা আলিশান বাড়ি। পাইকপাড়ায় শ্যালক তসলিম যে আলিশান বাড়িটিতে থাকেন, সেটিও নুরুন্নবীর করে দেওয়া বলে আলোচনা আছে। নামে-বেনামে এরই মধ্যে তিনি প্রচুর সম্পদ গড়ে তুলেছেন বলে বিভিন্ন মহলে শোনা যায়। রয়েছে দামি গাড়িও।</p> <p>খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে কারা অনু বিভাগের যুগ্ম সচিব সৈয়দ বেলাল হোসেনের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়। সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপসচিব মো. মনিরুজ্জামানের সমন্বয়ে তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। ওই কমিটি গত ৬ এপ্রিল ৫১ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে, যাতে কারাগারে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির কথা উঠে আসে।</p> <p>পরবর্তী সময়ে ২৮ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের কারা-১ শাখার উপসচিব মো. মনিরুজ্জামান কারা মহাপরিদর্শককে পাঠানো এক পত্রে তদন্ত কমিটির মতামত ও সুপারিশের আলোকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারের অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন। এর মধ্যে ২৬ কারারক্ষীর নাম উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি জেল সুপার, জেলার, ডেপুটি জেলার অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়।</p> <p>তবে জেল সুপার নুরুন্নবী ভূঁইয়া এসব অভিযোগ অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, একটি বেনামি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত হয়। অসৎ মানুষের পাল্লায় পড়ে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, ‘বদলির অর্ডার হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এ বিষয়েও যাচাই-বাছাই চলছে। যাচাই-বাছাই শেষ না হওয়া পর্যন্ত তো কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ সঠিক বলা যাবে না। আমরা ভিকটিম, এর বাইরে আর কিছু বলার নাই।’</p> <p>স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, কারাগারে সব ক্ষেত্রেই অনিয়ম-দুর্নীতি রয়েছে। বন্দি প্রবেশ-বের হওয়া কোনো কিছুই টাকা ছাড়া মেলে না। টাকা দিলে সেখানে অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করা হয়। আর এসবের সঙ্গে জেল সুপার নুরুন্নবী ভূঁইয়া, জেলার এ জি মাহমুদ, ডেপুটি জেলার হুমায়ুন কবির, প্রধান কারারক্ষী মো. ওয়াহেদসহ সংশ্লিষ্টরা জড়িত।</p> <p>তদন্ত প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা যায়, কারাগারে টাকা দিলে আয়েশে থাকা যায়। এক হাত জায়গা বিক্রি হয় তিন হাজার টাকায়। বন্দিদের কম্বল পেতে দিতে হয় পাঁচ হাজার টাকা। কারাগারের হাসপাতালটি যেন আবাসিক হোটেলে পরিণত করা হয়েছে। মোটা অঙ্কের টাকা দিলে সেখানে সুস্থ মানুষেরও থাকার ব্যবস্থা হয়।</p> <p>কারাগারে খাবার বিতরণে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, শিশুদের খাবারই দেওয়া হয় না। ছোট এক গ্লাস দুধ দেওয়া হয়, তাও পানি মেশানো। বন্দিদের জন্য যে রুটি সরবরাহ করা হয়, তা অত্যন্ত নিম্নমানের ও খাবার অনুপযোগী।</p> <p>প্রতিবেদনে বলা হয়, কারাগারে বন্দিদের এনে প্রথমে যে কক্ষে রাখা হয়, সেটিকে আমদানি কক্ষ বলে। ওই কক্ষে থাকা বন্দিদের ‘গরু’ বলা হয়। সেখান থেকে বন্দিদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে পাঠাতে টাকা আদায় করা হয়। হাসপাতাল ছাড়া অন্যান্য ওয়ার্ডে থাকতে চাইলে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা করে নেওয়া হয়। কারারক্ষীদের পাশাপাশি পুরনো বন্দিরা এসব নিয়ন্ত্রণ করে। টাকা দিতে অক্ষম বন্দিদের ওপর নির্যাতনও চালানো হয়।</p> <p>কারা ক্যান্টিন পরিচালনায় অনিয়ম-দুর্নীতির কথাও উঠে আসে তদন্ত প্রতিবেদনে। উল্লেখ করা হয়, মূল্য তালিকা প্রদর্শন করা থাকলেও সেখানে মূল্য নির্ধারিত ছিল না। প্রতিটি পণ্যই দুই-তিন গুণ দামে বিক্রি করা হয়। কেনা পণ্য বিক্রির বিপরীতে মূল্য পিসি (প্রিজনার ক্যাশ) থেকে কাটার ক্ষেত্রেও ফাঁকি দেওয়া হয়।</p>