<p>কী করে পুরো জেলাকে ভিক্ষুকমুক্ত করা যায়, তা-ই ছিল ধ্যানজ্ঞান। সেই চেষ্টা সফল হওয়ার পথে। শিগগির নড়াইলকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের প্রথম ভিক্ষুকমুক্ত জেলা ঘোষণা করা হবে। কিন্তু এ কাজ যিনি রাতদিন খেটে করলেন, সেই অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. সিদ্দিকুর রহমানকে স্থানীয়  লোকজন ডাকে ‘ভিক্ষুক স্যার’ বলে।</p> <p>জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জরিপের মাধ্যমে নড়াইল সদরে ৩০৪, লোহাগড়ায় ২২৮ ও কালিয়া উপজেলায় ২৬৬ (মোট ৭৯৮) জন ভিক্ষুক পাওয়া <img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2017/Print-2017/February/7-2-2017/First-back/kalerkantho-07-02-2017-52.jpg" style="border-style:solid; border-width:2px; float:left; height:628px; margin:12px; width:261px" />যায়। এর মধ্যে নারী ৫৫৫ ও পুরুষ ২৪৩ জন। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচটি গরু, পাঁচটি ওজন পরিমাপক যন্ত্র, ছয়টি সেলাই মেশিন, ৩০৭টি ছাগল, ৯১০টি হাঁস, ২৯০টি মুরগি, ১৩টি ভ্যান, ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য ২৫৩টি দোকান, দুই বান্ডিল টিন ও ছয় হাজার টাকা দেওয়া হয়। আটজনকে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের মাধ্যমে ৬২৪ জনকে সদস্য করে উৎসাহ বোনাস ও আবর্তক ঋণ দেওয়া হয়। বর্তমানে তাদের পুঁজি দাঁড়িয়েছে ৪৭ লাখ টাকা। প্রাপ্যতার ভিত্তিতে ২৭৫ জনকে বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ও মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান এবং জিআরসহ ১০ টাকা কেজি দরের চালের সুবিধার আওতায় আনা হয়। তহবিল হিসাবে জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ থেকে সাত লাখ, সমাজসেবা অধিদপ্তর ছয় লাখ ৬০ হাজার, জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অনুদান মিলিয়ে মোট ২৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা সঞ্চয় জমা হয়।</p> <p>দেখভাল করতে প্রতিজন ভিক্ষুকের বিপরীতে এলাকার একেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে তদারকির দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গঠিত হয়েছে ইউনিয়ন, উপজেলা/পৌরসভা, জেলা বাস্তবায়ন ও পুনর্বাসন কমিটি। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য সহকারী, চৌকিদারসহ সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের চাকরিজীবীরা স্বেচ্ছাশ্রমে পুনর্বাসিত ভিক্ষুকদের তদারকি করেন। প্রতি মাসে একবার করে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে মাসিক সভা হয়।</p> <p>নড়াইলের কালনা ফেরিঘাটে গত ১৫ জানুয়ারি বাদাম, চানাচুর, পেয়ারা, আমড়া ও ডিম বিক্রি করছিলেন অন্ধ ফারুক (৫২)। গলায় ঝুড়ি ঝুলিয়ে বাদাম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই শোনা গেল, ‘এই বাদাম, বাদাম। আসেন ভাই, বাদাম কিনে খান। আপনার ছোট শিশুকে খাওয়ান। আমি অন্ধ ফারুক। আগে হাত পেতে ভিক্ষা নিতাম। এখন আপনাদের বাদাম খাওয়াই।’ পথচারীরা দাঁড়িয়ে বাদাম কিনছে হাসিমুখে। কয়েক দিন আগে তাঁর যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচার জন্য তারা ঘুরে যেত।</p> <p>ফারুক বলেন, ‘১৯৭৭ সালে ১১ বছর বয়সে প্রথম ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছিলাম। অন্ধ হলেই ভিক্ষা করতে হবে, এটাই মেনে নিয়েছিলাম। মানুষকে আকৃষ্ট করতে কত রকমের ছলচাতুরী করতে হয়েছে। প্রতিদিন মনে হতো পরের দয়ায় বেঁচে আছি। গত বছর সেই পেশা ছেড়ে দিয়েছি। এখন নিজে আয় করে খাই। টাকা আগের থেকে কিছু কম হলেও কারো দয়ায় চলতে হচ্ছে না, এটাই বড় আনন্দ।’</p> <p>তাঁর ব্যবসার উপকরণের জন্য টাকা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। ফারুক বলেন, ‘প্রথম প্রথম ভিক্ষুক স্যারের (সিদ্দিকুর রহমান) ওপর খুব রাগ হতো। আমি বিনা পুঁজির ব্যবসা করতাম। এটা ওনার সহ্য হলো না। পরে দেখলাম নিজে কাজ করে খাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ তা ভিক্ষা করে পাওয়া যায় না। এখন আর ছেলে-মেয়েদের কেউ ভিখারির সন্তান বলবে না। বলবে ব্যবসায়ী ফারুকের সন্তান। আমি সুখেই আছি।’</p> <p>একইভাবে ১১ বছরের ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়েছেন রূপগঞ্জ বাজারের ৬৩ বছরের বৃদ্ধ জামাল হোসেন। এখন তিনি তরকারি বিক্রি করে দৈনিক ২০০ টাকা আয় করেন। স্ত্রী ববিতা মিষ্টির প্যাকেট তৈরি করেন পাশের কয়েকজন নারীর সঙ্গে। দুজনের আয়ে আগের চেয়ে ভালো চলছে তাঁদের সংসার।</p> <p>২২ বছর ধরে নড়াইল-যশোর বাসে ভিক্ষা করতেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী লিটন শেখ (৪৫)। এখন তিনি বাসযাত্রীদের কাছে বাদাম বিক্রি করেন। লিটনের মতো ২০ জন দৃষ্টিহীন, দুজন বধির, দুজন বাক্শক্তিহীন, ৩৯ জন প্রতিবন্ধীসহ প্রায় হাজার ভিক্ষুকের হাত এখন কর্মীর হাতে পরিণত হয়েছে।</p> <p>উল্লেখ্য, সিদ্দিকুর রহমান ২০১৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি নড়াইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) হিসেবে যোগ করেন। এর আগে তিনি ২০১৪ সালে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) থাকাকালে উপজেলাটিকে ভিক্ষুকমুক্ত করেন।</p> <p>নড়াইল শহরের গৃহকর্ত্রী লুত্ফুন্নাহার বলেন, ‘আগে শুক্রবারে ভিক্ষুকের যন্ত্রণায় স্বাভাবিক কাজকর্ম করা যেত না। এখন কোনো ভিক্ষুক দেখা যাচ্ছে না। খুচরা টাকা বাড়িতে জমে যাচ্ছে। তবে সমস্যা হলো, এখন ইচ্ছা করলেই ফকির খাওয়ানোর মতো কাউকে পাওয়া যায় না। ভাবতেই ভালো লাগে যে আমাদের জেলা ভিক্ষুকমুক্ত।’</p> <p>জেলা মুক্তিযোদ্ধা ডেপুটি কমান্ডার এস এ মতিন বলেন, ‘দেশ স্বাধীন করেছিলাম অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার জন্য। তা আমরা আজও পারিনি। তবে সরকারি প্রচেষ্টা আর এলাকার মানুষের আন্তরিকতার ফলে নড়াইল জেলা ভিক্ষুকমুক্ত হয়েছে, এটা অত্যন্ত গর্বের বিষয়। এ কাজের জন্য ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য প্রশাসক সিদ্দিকুর।’</p> <p>অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আগামী দুই বছরের মধ্যে সব ভিক্ষুক দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠবে। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে, সেখানে নড়াইল রোল মডেল (পথিকৃৎ) হিসেবে আবির্ভূত হবে, এ লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’</p> <p>নড়াইলের জেলা প্রশাসক (ডিসি) হেলাল মাহমুদ শরীফ বলেন, ‘জেলাভিত্তিক নড়াইলই আমরা প্রথম ভিক্ষুকমুক্ত করার কাজে হাত দিয়েছি। সব ভিক্ষুকের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করতে চাই। তবে কিছু আছে, যারা স্বভাবী ভিক্ষুক, তাদের ফিরিয়ে আনতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। শিগগির সরকারিভাবে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নড়াইলকে ভিক্ষুকমুক্ত জেলা হিসেবে ঘোষণা দেবেন বলে আমরা আশা করছি।’</p> <p><a class="title hidden-xs hidden-sm" href="http://www.kalerkantho.com/print-edition/priyo-desh/2017/02/07/460853" title="">কিশোরগঞ্জ উপজেলাকেও বদলে দিয়েছিলেন তিনি</a></p>