এই ঘোলই বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া হবে বাজারে। ছবি : সংগৃহীত
১৯২২ সাল। আমার দাদা সাদেক আলী খান তখন বয়সে তরুণ। চলে যান রাজশাহী, কামারের কাজ শিখতে। কয়েক দিন পর ফিরে এসে তিনি শুরু করলেন ঘোল-মাঠা তৈরির কাজ।
বিজ্ঞাপন
দেশভাগের পর আশপাশের ঘোষ সম্প্রদায়ের লোকজন ভারত চলে যায়। ফলে দাদার ঘোল আর মাঠার চাহিদা বাড়ে। দাদার চার ছেলে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সলপে রেলস্টেশন আবার নতুন করে চালু হয়। চাচারা সবাই তখন বেশ বড়। দাদা ঠিক করলেন দোকান চার ছেলের মধ্যে ভাগ করে দেবেন। তখন একটা দোকান ভেঙে হলো তিনটা। বড় চাচার একটা, সেজো চাচার একটা, আমার বাবা আর মেজো চাচার একটা। দাদা মাচালের ওপর বসে সব তদারকি করতেন। ১৯৮৬ সালে তিনি মারা যান। এরপর মেজো চাচাও আমাদের থেকে আলাদা হয়ে যান। ১৯৯৮ সালে বড় চাচা দোকান বন্ধ করে দেন। ২০০২ সালের দিকে এসে মেজো ও সেজো চাচাও সে পথে হাঁটলেন। তবে বাবা হাল ছাড়েননি।
সলপে আগে প্রতিদিন ১০-১২টি করে ট্রেন থামত। সেসব ট্রেনের কাপড়ের ব্যবসায়ীরা যেতেন কলকাতায়। তাঁরাই ছিলেন আমাদের প্রথম দিকের ক্রেতা। কাপড়ের সঙ্গে তাঁরা নিয়ে যেতেন ঘোল-মাঠা। তবে ১৯৮৮ সালের বন্যার পর এই এলাকায় ট্রেন ডাকাতি বেড়ে যায়। কিছুদিন পর পাশের উল্লাপাড়ায় রেলস্টেশন চালু হলে সলপে স্টেশন বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে সলপে হয়ে যায় একেবারে সুনসান। ব্যবসায়ও ভাটা পড়ে। এখন রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী একটি মাত্র লোকাল ট্রেন থামে সলপে। এই ট্রেনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘোল, মাঠা, ঘি পাঠাই। কিন্তু দিন দিন বিক্রি কমতে থাকে। ২০০৪ সালের দিকে ছোট ভাই ঢাকায় চলে যায় চাকরির আশায়। কিছুদিন পর আমিও দোকান বন্ধ করে দিলাম। পরে সিরাজগঞ্জ ডিসি অফিসে একটি ছোটখাটো চাকরির আবেদন করি। মৌখিক পরীক্ষা নেন সে সময়ের জেলা প্রশাসক আমিনুল স্যার। মৌখিক পরীক্ষার পর বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখি সেখানে স্থানীয় চৌবাড়ি কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল আজীজ সরকার ও স্থানীয় কিছু সাংবাদিক এসেছেন। তাঁরা আমাকে বোঝালেন ঐতিহ্যবাহী এই ব্যবসা বন্ধ করা ঠিক হবে না। পরের সপ্তাহে তাঁরা সবাই আমার দোকানে আসবেন বলে ফরমায়েশও দেন। তাঁদের উৎসাহে নতুনভাবে কাজ শুরু করলাম। তখন বেশ কিছু স্থানীয় পত্রিকা সলপের ঘোল নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তারপর দেখি নতুন নতুন ক্রেতা আসছে। এভাবে চলতে চলতে বৈশাখ মাস চলে এলো। আব্দুল আজীজ স্যার জানালেন, এবার নববর্ষে সিরাজগঞ্জবাসী পান্তা-ইলিশের বদলে খাবে সলপের ঘোল আর চিড়া। বৈশাখের দ্বিতীয় শুক্রবার ৩০০ জনের বিশাল একদল নিয়ে তিনি আমার দোকানে এলেন। এত মানুষ একসঙ্গে ঘোল খেতে এসেছে, এটা দেখতে আরো কয়েক শ মানুষ জড়ো হয়। খবরটা বাতাসের বেগে ছড়াল। এর পর থেকে প্রতি বৈশাখে সলপে ঘোল উৎসব হয়ে আসছে। আয়োজন করে সিরাজগঞ্জের প্রভাতী সংঘ।
এখন প্রতিদিন ১৪০ থেকে ১৫০ মণ দুধ সংগ্রহ করি স্থানীয় সমিতি থেকে। এক মণ দুধ থেকে প্রায় ৩০-৩৫ কেজির মতো ঘোল হয়, ঘি আসে মাত্র এক কেজি। এখন পাঁচ ধরনের খাবার তৈরি করি—ঘোল, মাঠা, দই, সরের ঘি, মাখনের ঘি। প্রতিদিন ভোরে গরুর দুধ আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা জ্বাল দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট সময় জ্বাল দেওয়ার পর পাত্রে করে সারা রাত রেখে দেওয়া হয় সেই দুধ। সকালে জমে থাকা সেই দুধের সঙ্গে চিনি ও অন্য উপকরণ মিশিয়ে তৈরি করা হয় এই সুস্বাদু পানীয়। ঘোল বিক্রি করি ৬০ টাকা লিটার, মাঠা ৮০ টাকা, দই ১২০ টাকা। ১৮ জন কর্মচারী আমার সঙ্গে কাজ করেন। ঘোলের চাহিদা বেশি থাকে রমজানে। গত রোজায় দৈনিক গড়ে প্রায় ৫০০ মণ বিক্রি হয়েছে। সিরাজগঞ্জে সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠান হলে অর্ডার আসে। কয়েক বছর আগেও এই তল্লাটে একটি মাত্র দোকান থাকলেও আমাদের কর্মচারী, কারিগর অনেকেই আলাদা দোকান দিয়ে বসেছেন। সবার দোকানের নাম শুরুই সলপে দিয়ে। এটাই ভালো লাগার জায়গা।