বগুড়ার মহাস্থানগড়ের পুরাকীর্তি বিষমর্দনসংলগ্ন পদ্মপুকুরের মাটি কেটে নেওয়া হয়। ছবি : কালের কণ্ঠ
পৌরাণিক কাহিনীতে রাজা রামচন্দ্র দেবী দুর্গার অকাল বোধনের জন্য যে জলাশয় থেকে নীলপদ্ম সংগ্রহ করেছিলেন—তার নাম ‘কালীদহ সাগর’। এই সাগরের দক্ষিণ তীরেই একটি ভিটা রয়েছে, যেটি ‘পদ্মপুকুর’ নামে পরিচিত। আর কিংবদন্তির বেহুলার শ্বশুর চাঁদ সওদাগর সর্পদেবী পদ্মার অভিশাপে সন্তানহারা হন। সেই সর্পদেবী পদ্মার বাড়ি—এই কালীদহ সাগরেরই মাঝে, যাকে বলা হয় ‘পদ্মার ভিটা’।
বিজ্ঞাপন
দেশের সর্বপ্রাচীন নগরী বা সমৃদ্ধ প্রাচীন জনপদের নাম উঠলেই উচ্চারিত হয় পুণ্ড্রবর্ধনের নাম। এই জনপদের রাজধানীটি কালের বিবর্তনে প্রোথিত হয়েছে মহাস্থানগড়ের ভূগর্ভে। ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই দুর্গনগরীর পশ্চিমাংশের সুরক্ষাবলয় ছিল কালীদহ সাগর। সেই বিশালাকায় জলাশয়ে ছিল নানা প্রজাতির সরীসৃপসহ জীববৈচিত্র্যের সমাহার। বর্তমানে মহাস্থানগড়ের মথুরা গ্রামের উত্তর পাশে এবং চিঙ্গাসপুর গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে এই ঐতিহাসিক স্থাপনার অবস্থান।
এই জনপদের ইতিবৃত্ত নিয়ে রচিত ‘পুণ্ড্র’ নামক গবেষণা গ্রন্থে অধ্যাপক মোস্তফা আলী পদ্মার ভিটা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, ‘পদ্মাবতীর বাড়ির ধ্বংসাবশেষটি দুর্গনগরীর পশ্চিম প্রাচীরের বাইরে প্রায় ৬০০ গজ পশ্চিমে কালীদহ সাগরের মধ্যে দ্বীপ আকারে অবস্থিত। এর ৩০০ গজ পূর্বে বিষমর্দন বা বিষপত্তন। এরও ৩০০ গজ পূর্বে দুর্গনগরীর পশ্চিম প্রাচীর। মহাস্থানগড়ের কালীদহ সাগরে অবস্থিত পদ্মার বাড়ি স্তূপটি আসলে সর্পপূজার কোনো মন্দির ছিল। ’
‘ইতিকথা-পৌণ্ড্রবর্ধন’ গ্রন্থে অধ্যাপক আব্দুল মান্নান কালীদহ সাগর সম্পর্কে উল্লেখ করেন, ‘মহাস্থানগড়ের উত্তর-পশ্চিম পাশ দিয়ে বিস্তৃত কালীদহ সাগর। পূর্বে এই কালীদহ সাগর বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ও গভীর ছিল। কথিত আছে, বিখ্যাত সওদাগররা কালীদহ সাগর দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য মহাস্থানগড়ে আসতেন। পূর্বে মহাস্থানগড়ের প্রায় সবদিকেই বিশাল জলরাশি বিদ্যমান ছিল। কালীদহ সাগরের মধ্যে পদ্মার বাড়ী ও বিষপত্তন নামে দুটি উঁচু ঢিবি বর্তমান। জনশ্রুতি আছে, পদ্মার বাড়ি নামক জায়গায় সর্পদেবী পদ্মার বাড়ী ছিল। পদ্মাদেবী সব সাপের বিষ বিষপত্তন নামক স্থানে জমা রাখতেন। ’
তাঁদের উল্লিখিত এই দুই ঐতিহাসিক নিদর্শনের পাশেই ছিল পদ্মপুকুর ও পুরনো বাড়ি (স্থানীয়দের মতে, প্রাচীন রাজবাড়ি) নামের দুটি স্থাপনা। সেই দুই স্থাপনার মাটি কেটে ধ্বংস করা হয়েছে। পুরনো বাড়িতে এখনো একটি এবং পদ্মপুকুরে দুটি এক্সকাভেটর মেশিন লাগিয়ে রাখা হয়েছে মাটি কাটার জন্য। মাটি কাটা স্থানে এখনো বেশ কিছু প্রাচীন মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষ পড়ে আছে। এ ছাড়া পুরনো বাড়িতে একটি পাতকুয়া ও পদ্মপুকুরে ছয়টি পাতকুয়া বেরিয়ে এসেছে।
মথুরা মোন্নাপাড়ার বাসিন্দা খোকা মিয়া জানান, এসব পাতকুয়ার সন্ধান পাওয়ার পর তার ভেতর যা আছে—তা বিক্রি করে দেয় মাটিখেকোরা। স্থানীয় কিছু লোক সেই কুয়া কিনে নিয়ে ভেতরে প্রাচীন আমলের জিনিসপত্রের সন্ধান করে।
একই গ্রামের মনোয়ার হোসেনের স্ত্রী রত্না বেগম জানান, পদ্মপুকুরের ভিটাটি তাঁদের। সেখানে যে ছয়টি কুয়া বের হয়েছে, তার মধ্যে বেশ কিছু মৃৎপাত্র পাওয়া যায়। মৃৎপাত্রের কয়েকটি স্থানীয় শফিকুলের ছেলে বক্কর ও নজরুলের ছেলে শান্ত নিয়ে গেছেন।