কেন্দ্রে কেন্দ্রে করোনার টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। গতকাল দুপুরে ময়মনসিংহের নান্দাইলের খামারগাঁও উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে তোলা। ছবি : কালের কণ্ঠ
আগে তেমন কোনো প্রচার ছিল না, তার পরও বাড়ির কাছে উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিক বা কারো বাড়ির বাংলাঘরে করোনার টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করায় গ্রামবাসীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ দেখা দিয়েছে। গতকাল সোমবার সকালে কয়েকটি উপজেলার বেশ কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, বাড়ির পাশে টিকা পেয়ে লোকজন এই গণটিকা কার্যক্রমের প্রশংসা করছেন।
ময়মনসিংহের নান্দাইলের মোয়াজ্জেমপুর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের ছোবহানের বাড়িতে টিকা দেওয়ার একটি কেন্দ্রে গিয়ে জানা যায়, গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত প্রায় ৯০০ জনকে সিনোফার্মের প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এই কেন্দ্র থেকে টিকা নেওয়া কৃষক মোতালেব হোসেন (৫৫) বলেন, ‘আগে টিকা অনেকেই দিছে নানান ঝামেলা করে।
বিজ্ঞাপন
চণ্ডীপাশা ইউনিয়নের খামারগাঁও উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, শতাধিক ব্যক্তি টিকা নিতে কেন্দ্রে ভিড় জমিয়েছেন। আগে থেকে নিবন্ধন না থাকলেও জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে টিকা নিচ্ছেন। জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকলেও বয়স ১৮ হয়েছে আন্দাজ করেও টিকা দেওয়া হচ্ছে। কাউকেও ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। কেন্দ্রটি থেকে আজাহারুল ইসলাম (২০) ও মোমেনা আক্তার (২৫) জানান, তাঁরা দুই মাস আগে টিকা নেওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছিলেন। কিন্তু মোবাইলে এখনো এসএমএস আসেনি। এ অবস্থায় এখানে এসে জানতে পেরেছেন টিকা নেওয়া যাবে। তাই সুযোগ হাতছাড়া করেননি।
কেন্দ্রটি পরিদর্শনে এসে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মাহমুদুর রশিদ বলেন, প্রচারে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। এ জন্য অনেক কেন্দ্রেই নিবন্ধন না থাকার কারণে লোকজন যাননি। তবে যাঁরা কেন্দ্রে গেছেন, সবাই টিকা নিয়েছেন। উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে গতকাল ছয়টিতে ১৮টি সাব-ব্লকে টিকাদান কেন্দ্র করা হয়। সিনোফার্মের প্রায় ১০ হাজার ডোজ বিতরণ করা হয়েছে। এভাবেই বাকি ছয়টি ইউনিয়নে মঙ্গলবার (আজ) একই পদ্ধতিতে টিকা কার্যক্রম চলবে। সপ্তাহে দুই দিন করে একটি ওয়ার্ডের আটটি ব্লকে টিকা কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
চাঁদপুর সদর উপজেলার ব্রাহ্মণসাখুয়া গ্রামে গিয়ে জানা যায়, জেলা শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরের গ্রামটিতে করোনার টিকা নিয়ে পৌঁছেছেন স্বাস্থ্যকর্মী জাফর গাজী। গ্রামবাসীরা টিকা নিতে হাজির। মোস্তফা কামাল নামের এক বৃদ্ধ বলেন, ‘খুব সহজেই বাড়ির কাছে করোনার টিকা পেয়ে গেলাম। ’ আব্দুল মোতালেব (৫০), রাবেয়া বেগমসহ (৪৫) আরো কয়েকজন টিকা গ্রহণ করলেন। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত গ্রামের অনেক নারী ও পুরুষকে টিকা নিতে দেখা যায়।
এই কেন্দ্রের কর্মকর্তা ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, ‘প্রতিটি কেন্দ্রে ৩০০ জনকে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মানুষের বেশ আগ্রহ লক্ষ করছি। ব্রাহ্মণসাখুয়া ইপিআই কেন্দ্রে টিকা প্রদানের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল, তা পূরণে আমরা সফল হয়েছি। ’
দুপুরে এই কেন্দ্র পরিদর্শনে আসেন সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সাজেদা বেগম পলিন। তিনি বলেন, ‘উপজেলার সব ইপিআই কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিককে আমরা করোনা টিকার কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছি, যাতে গ্রামের সাধারণ মানুষ তাদের ঘরের পাশে করোনার টিকা সহজেই গ্রহণ করতে পারে। ’
চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডা. শাহাদাত হোসেন জানান, ১ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই টিকা কার্যক্রমের আওতায় আট হাজার ব্যক্তিকে করোনার টিকা দেওয়া হয়েছে। আউটরিচ অর্থাৎ দূরবর্তী কেন্দ্র হিসেবে ইপিআই কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিককে বেছে নেওয়া হয়েছে। সরকারের এমন সিদ্ধান্তের কারণে এখন বাড়ির কাছে সাধারণ মানুষ করোনার টিকা নিতে পারছেন। এসব কেন্দ্রে প্রথম ডোজ হিসেবে সিনোভ্যাক্স দেওয়া হচ্ছে। দ্বিতীয় ডোজ হিসেবেও সিনোফার্মের টিকা দেওয়া হতে পারে। আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে চাঁদপুরের আট উপজেলার দুই হাজার ২০০ কেন্দ্রে এই টিকা কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
এদিকে ঠাকুরগাঁওয়ে পর্যাপ্ত প্রচারের ঘাটতির কারণে গ্রাম পর্যায়ে গণটিকা কার্যক্রমের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রচারের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নেই। তবে মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা আন্ত যোগাযোগের মাধ্যমে প্রচার চালিয়েছেন। সদর উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের আরাজি চণ্ডীপুর বাজার এলাকার মুদি দোকানি ষাটোর্ধ্ব আকছেদ আলী খান জানান, টিকার জন্য অনলাইনে নিবন্ধন করেছেন, কিন্তু কাজের চাপে শহরে টিকা নিতে যাওয়া সম্ভব হয়নি। গত রবিবার যে বাড়ির পাশে গণটিকা দেওয়া হয়েছে, সেটি তিনি জানতে পারেননি। এলাকায় কোনো মাইকিংও হয়নি।
আকছেদ আলী খানের মতো তৃণমূল পর্যায়ের অনেকেই জানেন না কোথায় কখন টিকা দেওয়া হবে। গত রবিবার একই এলাকায় ডা. স্বপনের বাড়ির সামনে এক টিকাকেন্দ্রে মোকছেদ আলী নামের একজন জানান, তিনি কিছুদিন আগে ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে টিকা নিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ লাইনের কারণে দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে অপেক্ষার পর টিকা না নিয়েই ফিরে এসেছিলেন। গ্রামে করোনা টিকা দেওয়া হচ্ছে শুনে তিনি টিকা গ্রহণ করতে এসেছেন। কৃষক আকতারুল ইসলাম জানান, তিনি গমক্ষেতে পানি দিচ্ছিলেন। ক্ষেতের পাশের রাস্তা দিয়ে যাওয়া কয়েকজনের কথায় জানতে পেরে তিনি টিকা নিতে এসেছেন।
প্রসঙ্গত, নতুন বছরের প্রথম দিন গত শনিবার সারা দেশে গ্রাম পর্যায়ে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। এ কার্যক্রম চলবে এক মাস।
[প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়েছেন কালের কণ্ঠের আঞ্চলিক ও স্থানীয় প্রতিনিধিরা]