<p>বাংলাদেশে লাইসার্জিক এসিড ডাই-ইথ্যালামাইডের (এলএসডি) বাজার তৈরি করতে চার বছর ধরে গোপনে অপচেষ্টা চালাচ্ছেন মাদক কারবারিরা। এ জন্য ফেসবুক, টেলিগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপভিত্তিক প্রচার চালানো হচ্ছে। আর শিক্ষার্থীসহ অনেকেই না বুঝে ভয়ংকর ক্ষতিকর এই মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে।</p> <p>রাজধানীতে প্রথম দিকে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র সাদমান সাকিব রূপলসহ তিনটি গ্রুপ কারবার শুরু করে। এর পর থেকে গত চার বছরে অন্তত ১৫টি গ্রুপ তৈরি হয়েছে। এসব গ্রুপে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে, যারা অনলাইনে পার্সেলে, লাগেজে ও বইয়ের মধ্যে এলএসডি এনে বিক্রি করছে।</p> <p>গত চার বছরে ঢাকায়ই প্রায় ৭০০ এলএসডিসেবী তৈরি হয়েছে। স্ট্যাম্প বা টিকিটের মতো দেখতে কাগজ নেশাদ্রব্য হিসেবে গ্রহণ করায় বিষয়টি প্রশাসন তো দূরের কথা, পরিবারের লোকজনের চোখেও সহজে ধরা পড়েনি। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনায় এলএসডিসেবীদের মধ্যেও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।</p> <p>তদন্তসংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), থানা পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। দুটি গ্রুপের আটজনকে গ্রেপ্তারের পর প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এখন এলএসডির বিক্রেতা ও ক্রেতাদের খোঁজা হচ্ছে। পাশাপাশি এলএসডির উৎসও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।</p> <p>এদিকে গত শনিবার রাতে পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচজনকে গতকাল সোমবার পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ঢাকা মহানগর হাকিম আতিকুল ইসলামের আদালতে তাঁদের হাজির করে খিলগাঁও থানার তদন্ত কর্মকর্তা ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত এই আদেশ দেন। তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, রিমান্ডে থাকা আটজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে চক্রের তথ্য সংগ্রহ ও গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।</p> <p>ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আব্দুল আহাদ বলেন, ‘আমরা ১৪-১৫টি দলের ব্যাপারে তথ্য পেয়েছি। আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে এই মাদকের কারবার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হবে।’</p> <p>পুলিশ সূত্র জানায়, শনিবার রাতে প্রথমে মালিবাগে কমিউনিটি সেন্টারের সামনে থেকে সাইফুল ইসলাম ওরফে সাইফ, এস এম মনওয়ার আকিব ওরফে আনান ও নাজমুস সাকিব নামে তিনজনকে আটক করা হয়। তাঁদের কাছে গাঁজার সঙ্গে পাঁচটি এলএসডি ব্লট পাওয়া যায়। হাফিজের মৃত্যুর পর ডিবির অভিযানে আলোচনায় আসায় এলএসডি ব্লট দেখে পুলিশ সদস্যরা প্রাথমিকভাবে চিনে ফেলেন। তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে খিলগাঁও থানা পুলিশ বারিধারায় চৌধুরী লাউঞ্জে অভিযান চালিয়ে নাজমুল ইসলাম ও বি এম সিরাজুস সালেকীন ওরফে তপু নামে দুজনকে আটক করে। তাঁদের কাছ থেকেও ছয়টি ব্লট ও গাঁজা উদ্ধার করা হয়েছে। পরে নাজমুলের দেওয়া তথ্য মতে মহাখালী টিবিগেট এলাকায় তাঁর শ্বশুরবাড়িতে অভিযান চালিয়ে চার পিস এলএসডি ব্লট ও এক গ্রাম আইস পাওয়া যায়। এই গ্রুপ এক বছর ধরে এলএসডির সঙ্গে আইসসহ বিভিন্ন মাদক সংগ্রহ করে সেবনের ব্যবস্থা করে আসছিল। অ্যাপে এই মাদকচক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকা বেশির ভাগই শিক্ষার্থী। চক্রটি অনলাইনে ইউরোপ থেকে এলএসডি নিয়ে আসে বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে।</p> <p>খিলগাঁও থানার ওসি ফারুকুল আলম বলেন, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে একজন এনজিওকর্মী, দুজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং দুজন কলেজের ছাত্র। তাঁদের পরিচয় ও কারবারের ব্যাপারে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।</p> <p>গত ১৫ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় তাঁর তিন বন্ধু এলএসডি সেবন করান। এর প্রতিক্রিয়া শুরু হলে তিনি শুধু একটি শর্টস পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে গিয়ে এক ডাব বিক্রেতার ভ্যানে রাখা দা নিয়ে নিজের গলায় আঘাত করেন। পরে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। এমন তথ্য পেয়ে বুধবার হাফিজুরের বন্ধু নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ শিক্ষার্থী সাদমান সাকিব ওরফে রূপল ও আসহাব ওয়াদুদ ওরফে তূর্জ এবং ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র আদিব আশরাফকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। ২০০ এলএসডিসহ গ্রেপ্তারের মামলায় পাঁচ দিনের রিমান্ডে আছেন ওই তিনজন।</p> <p>ডিবির সূত্র জানায়, রূপল টেলিগ্রাম অ্যাপের মাধ্যমে নেদারল্যান্ডসের টিম নামের এক নাগরিকের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেন। তাঁর কাছ থেকে চার বছরে পার্সেলে সাতটি চালান এনেছেন রূপল ও তাঁর সহযোগীরা। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বইয়ের ভেতরে লুকিয়ে এলএসডি আনা হয়। রূপলের আগে আরো দুজন নেদারল্যান্ডসের টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাদের একজনের মাধ্যমে টিমের সঙ্গে রূপলের যোগাযোগ হয়। পরে আলাদাভাবে এলএসডি নিয়ে আসেন। তিনি পুরোদমে ফেসবুক গ্রুপ ‘আপনার আব্বা’ তৈরি করে মাদকের কারবার করছেন এক বছর ধরে। এলএসডি কারবারের এই তিন গ্রুপ চার বছরে ঢাকায় অন্তত ৭০০ এলএসডিসেবী তৈরি করেছে। তারাই আবার নেটওয়ার্ক তৈরি করে বিক্রেতা হয়ে উঠছে।</p> <p>২০১৯ সালের ১৪ জুলাই দেশে প্রথম মহাখালী ডিওএইচএস এলাকা থেকে পাঁচ মিলিগ্রাম তরল এলএসডি, ৪৬ ব্লটসহ ইয়াসের রিদওয়ান আনান ও সৈয়দ আহনাদ আতিফ মাহমুদ নামের দুই বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে ডিএনসি। ওই সময় কানাডা থেকে এলএসডি আনার তথ্য পাওয়া গেলেও কারবারের সূত্র মেলেনি। এর পর থেকে কার্যত নজরদারির বাইরেই ছিল এলএসডির কারবার।</p> <p>ডিএনসির উপপরিচালক (ঢাকা উত্তর) মুকুল জ্যোতি চাকমা বলেন, ‘দেশে আমরাই প্রথম এলএসডি ধরি। এরপর নজরদারি থাকলেও ওরা কিভাবে এই কারবার চালাচ্ছে, তা ধরা পড়েনি। আবার অনলাইনে যোগাযোগ ধরার ক্ষেত্রে আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।’</p>