<p>দক্ষিণমুখী কপোতাক্ষ নদের পশ্চিম পাশে সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়ন। পূর্ব পারে খুলনার কয়রা উপজেলা। প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্ফান হয়ে যাওয়ার ২০ দিন পরও প্রতাপনগরের ১৭ গ্রামের মানুষ নোনা পানিতে ‘নাকানি-চুবানি’ খাচ্ছে। ভেঙে যাওয়া বাঁধ এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামত করেছিল, কিন্তু গেল পূর্ণিমায় জোয়ারের পানিতে তা আবার ভেসে গেছে। ফলে জোয়ারের নোনা পানি থেকে আপাতত মুক্তি মিলছে না মানুষের।</p> <p>প্রতাপনগর ইউনিয়নে মোট গ্রামের সংখ্যা ১৮টি। ২৯ হাজার মানুষের বাস। এর মধ্যে ১৭টি গ্রামেই জোয়ারের পানি উঠছে-নামছে।</p> <p>সরেজমিনে দেখা যায়, কপোতাক্ষ তীরের চাকলার ক্লোজার, শ্রীপুর লঞ্চঘাট, আবাদেরকোলা, কুড়িকাহনিয়ার হবি সরদারের বাড়িসংলগ্ন রুহুল গাজীর বাড়ি, অমেদ আলীর বাড়ি, ঋষি পরিবার, সুভদ্রাকাটি মসজিদের পাশে, রুইয়ের বিল, হরিশখালীর তিনটি স্থান, খোলপেটুয়া নদীর তীরবর্তী কোলা ও গলঘেষিয়া নদীর তীরবর্তী হিজলিয়া গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এর ফলে চাকলা, চুইবাড়িয়া, দিঘলার আইট, সুভদ্রাকাটি, রুইয়ের বিল, শ্রীপুর, কুড়িকাহনিয়া, প্রতাপনগর, মাদারবাড়িয়া, কল্যাণপুর, খাজরা, শিরষা, নাকনা, সোনাতনকাটি, কোলা ও হিজলিয়া গ্রামের ২৭ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। শুধু ৯নং ওয়ার্ডের গোকুলনগর গ্রামটিকে নোনা পানি ছোঁয়নি।</p> <p>আম্ফানের পরপরই এলাকাবাসী বাঁধের ভাঙন ঠেকাতে রিংবাঁধ দিতে শুরু করে। টানা পাঁচ দিন কাজ করে গত শনিবার শ্রীপুরে বাঁধের কাজ শেষ হয়। কিন্তু পরদিন রবিবার পূর্ণিমার জোয়ারের তোড়ে সেই বাঁধ আবার ভেঙে যায়। এলাকাবাসীর শ্রম নোনা পানিতে ‘মিশে যায়’। অনেকের বাড়িতে থাকা জিনিসপত্র, ধান ভিজে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। গোটা এলাকা, তালতলা বাজার, মাদিয়া এলাকার পিচের রাস্তা—সব পানির নিচে। বসবাসের উপযোগী না থাকায় অনেকেই এলাকা ত্যাগ করছে। শ্রীপুর গ্রামের মোকলেসুর রহমান হালদার, মাকছু হালদারসহ কমপক্ষে ১০টি পরিবার গ্রাম ছেড়েছে। অনেকেই আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।</p> <p>প্রতাপনগর গ্রামের ব্যবসায়ী জহুরুল হক সরদার জানান, প্রতিদিন দুবার জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করায় মানুষ সহায়-সম্পদ হারানোর ভয়ের মধ্যে আছে। তিনি বলেন, ৫০ বছরে তিনি এমন দুর্যোগ দেখেননি। ৬০ বছর বয়সী নাকনা গ্রামের আদর আলী পাড় জানান, কপোতাক্ষ নদ ভাঙছে। এমন ভাঙন তিনি পাঁচ যুগেও দেখেননি। তাঁর চৌদ্দ পুরুষের বসবাস কপোতাক্ষের তীরে। পৈতৃক ভিটার ওপর দিয়ে আগে কখনো জোয়ার-ভাটার পানি যেতে দেখেননি।</p> <p>ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শেখ গোলাম রসুল জানান, আম্ফানের ধাক্কায় গ্রামের মধ্য দিয়ে নতুন একটি খালের সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৯ সালে আইলার ধাক্কায় আরো একটি খাল সৃষ্টি হয়ে গ্রামকে দুই ভাগ করে ফেলেছিল। আম্ফানের ধাক্কায় মানুষ রাস্তার ওপর কুঁড়েঘর তুলে মাথা গোঁজার ঠাঁই করেছে। চাকলা গ্রামের শেখবাড়ি, সরদারপাড়া, ঢালীবাড়ি, গাজীবাড়ি, মিস্ত্রি ও সানাপাড়া পানির নিচে রয়েছে। </p> <p>ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ জাকির হোসেন জানান, ইউনিয়নের সাত হাজার পরিবার সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে ভেঙে যাওয়া বাঁধ প্রথম দফায় মেরামত করে। পূর্ণিমার জোয়ারে তা ভেঙে যায়। এখন মানুষ দিশাহারা। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কবে কাজ শুরু করবে সেই আশায় আছি।’</p> <p>পাউবোর বিভাগীয় প্রকৌশলী নাহিদুল ইসলাম জানান, ভাঙনকবলিত ১১টি স্থানে সোনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে অচিরেই সংস্কারকাজ শুরু হবে। </p> <p>প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডরের ধাক্কায় এখানকার সুভদ্রাকাটি, হরিষখালী ও কোলাগ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলায় কপোতাক্ষের বেড়িবাঁধের ভাঙনে চাকলা, রুইয়ের বিল, সুভদ্রকাটি, চুইবাড়িয়া, দিঘলার আইট, শ্রীপুর, কুড়িকাহনিয়া ও সোনাতনকাটি গ্রামের মানুষ দুই মাসেরও বেশি সময় পানিবন্দি ছিল।</p>