রাজধানীর গোপীবাগের চাঞ্চল্যকর ছয় খুনের প্রায় দুই বছর পরে রহস্য উদ্ঘাটিত হলেও সব আসামিকে আজও শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। গত বছরের শেষ ভাগে বাড্ডায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ খিজির খান হত্যা মামলার এক আসামি ছয় খুনের মামলায়ও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। তারিকুল ইসলাম মিঠু নামের ওই আসামি জানায়, জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) ছয় সদস্য ছদ্মনামে মুরিদ সেজে গোপীবাগে হত্যাযজ্ঞ চালায়। সেখানে নিহত লুত্ফর রহমান ফারুক ছিলেন কথিত পীর।
বিজ্ঞাপন
২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর রাতে গোপীবাগের রামকৃষ্ণ মিশন রোডের ৬৪/৬ নম্বর চারতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলার বাসায় মুরিদ সেজে ঢুকে কথিত পীর লুত্ফর রহমান ফারুক, তাঁর ছেলে সারোয়ার ইসলাম ফারুক ওরফে মনির, খাদেম মঞ্জুর আলম মঞ্জু, মুরিদ শাহিন, রাসেল ও মুজিবুল সরকারকে জবাই করে দুর্বৃত্তরা। ঘটনার পরদিন নিহত লুত্ফর রহমানের ছোট ছেলে আবদুল্লাহ আল ফারুক অজ্ঞাতপরিচয় ১০-১২ জনকে আসামি করে ওয়ারী থানায় হত্যা মামলা করেন। থানা থেকে মামলার তদন্তভার গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়।
ডিবির পরিদর্শক কাজী গোলাম কবীর গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত বছর খিজির খান হত্যা মামলার আসামি মিঠু ছয় খুনের মামলায়ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। এতে রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। তবে অপর খুনিদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না। গাফফার নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও মাহফুজ, রনি, জাহিদ ও আতিককে এখনো পাওয়া যায়নি। এ নামগুলো খুনিদের ছদ্মনামও হতে পারে। ’ তবে নিহত লুত্ফর রহমান ফারুকের ছেলে এবং মামলার বাদী আবদুল্লাহ আল ফারুক গতকাল বলেন, ‘আমরা তদন্তের ব্যাপারে কিছুই জানি না। ঘটনার এত দিন পরও আমরা আতঙ্কে আছি। ’
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছরের ৫ অক্টোবর রাজধানীর মধ্য বাড্ডায় নিজের খানকাহ শরিফে গলা কেটে হত্যা করা হয় পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও পীর খিজির খানকে। ১৪ অক্টোবর টাঙ্গাইল থেকে জেএমবি সদস্য তারিকুল ইসলাম মিঠুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই বছরের ২৫ অক্টোবর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় মিঠু। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আরো চার আসামিকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। সুমন নামের আরেক আসামি আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। আসামিরা জানিয়েছে, জেএমবির একটি অংশের নেতাদের নির্দেশে প্রায় দুই বছর ধরে পীর ও মাজারের অনুসারীসহ ভিন্নমতাদর্শীদের হত্যার মিশনে নেমেছে তারা। গত বছরের ১৭ নভেম্বর মিঠুকে ছয় খুনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের নির্দেশে রিমান্ডে নেয় ডিবি পুলিশ। ২৭ নভেম্বর ঢাকার মহানগর হাকিম মাহবুবুর রহমান ছয় খুনের মামলায় মিঠুর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেন। ওই জবানবন্দিতে মিঠু নিজেকে ছাড়াও পাঁচজনের নাম প্রকাশ করে, যারা গোপীবাগে ছয় খুনে অংশ নেয়। বাকিরা হলো গাফফার, মাহফুজ, রনি, জাহিদ ও আতিক। মিঠু বলে, লুত্ফর রহমান ফারুক নিজেকে ইমাম মেহেদির সেনাপতি দাবি করে নিজস্ব তরিকা তৈরি করেন। তিনি মুরিদও তৈরি করেন। এ কারণে জেএমবির শীর্ষস্থানীয় নেতারা ফারুককে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
ডিবি সূত্র জানায়, খিজির খান হত্যা মামলার আসামিরাও জেএমবি কমান্ডার মাহফুজের নাম বলে। একই ব্যক্তি ছয় খুনে ছিল বলে জানায় মিঠু। গত বছরের ২৫ অক্টোবর রাজধানীর গাবতলীতে ডিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মাহফুজ ওরফে আলবানী ওরফে হোজ্জা নামের এক জঙ্গি নিহত হয়। সে আশুলিয়ায় পুলিশ সদস্য মুকুল হত্যা, হোসেনি দালানে বোমা হামলা এবং আশুলিয়ায় কমার্স ব্যাংকে ডাকাতির সময় আট খুনের মূল হোতা ছিল বলে দাবি করে ডিবি। তবে সেই মাহফুজই ছয় খুনে অংশ নেওয়া মাহফুজ কি না, তা নিশ্চিত নন তদন্তকারীরা।
ডিবির কর্মকর্তারা জানান, ২০১৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর তুরাগ থেকে জেএমবির একাংশের ভারপ্রাপ্ত আমির আব্দুল্লাহ আল তাসনীম ওরফে নাহিদসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জেএমবির পীর ও মাজারের অনুসারীদের হত্যার পরিকল্পনার তথ্য পায় গোয়েন্দারা। এরপর গোপীবাগের ছয় খুন ও রাজাবাজারে মাওলানা ফারুকী খুনের ঘটনায় জেএমবির জড়িত থাকার সন্দেহ করে তদন্তকারীরা। ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে তিন জঙ্গি ছিনতাইয়ের মামলায় গ্রেপ্তার আজমীর অমিত, গোলাম সরোয়ার রাহাত, জিয়াউল ইসলাম জিতু ও আল আমীন জেলহাজতে ছিল।