দেশে প্রতিবছর অন্তত ১০ হাজার মানুষের কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পড়ে, কিন্তু প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে গড়ে সর্বোচ্চ ৩৬৫ জনের, যা প্রয়োজনের মাত্র ৩.৬৫ শতাংশ। প্রতিস্থাপন-পরবর্তী ওষুধ ও চিকিৎসা না পেয়ে অর্ধেকের মৃত্যু হয় পাঁচ বছরের আগে।
দেশের কিডনি প্রতিস্থাপনসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এই তথ্য জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা এখন প্রায় তিন কোটি ৮০ লাখ।
এর মধ্যে ৪০ হাজার রোগী ডায়ালিসিসের ওপর নির্ভরশীল। এ পর্যন্ত দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে তিন হাজার ৫০০টির কিছু বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কিডনি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে আইনগত নানা জটিলতার কারণে একদিকে সচ্ছল রোগীরা কাছের দেশগুলোতে চলে যাচ্ছে, অন্যদিকে দরিদ্র রোগীরা ডায়ালিসিস পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারছে না। তারা শরীরে যন্ত্রণা নিয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
এমন পরিস্থিতিতে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব কিডনি দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৩ মার্চ দিবসটি পালিত হয়। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘আপনার কিডনি কি ভালো আছে?’
বাংলাদেশে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয় আশির দশকে। এরপর চার দশকের বেশি সময় কেটে গেলেও সরকারি পর্যায়ে এর চিকিৎসাসেবা তেমন এগোয়নি।
একমাত্র বিশেষায়িত সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি (এনআইকেডিইউ) হাসপাতালে এখন পর্যন্ত কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে মাত্র ৬০টির মতো।
এনআইকেডিইউ হাসপাতালের ইউরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. শওকত আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের এখানে ২০০৫ সালে অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম প্রথম কিডনি প্রতিস্থান শুরু করেন। তখন প্রতিবছর তিন-চারটা প্রতিস্থাপন হতো। মাঝে আবার একবারে কমে যায়। এরপর আমি প্রশিক্ষণ শেষে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু করি।
তবে সেটি নিয়মিত হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি পর্যায়ে কিডনি প্রতিস্থাপন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। আমাদের এখানে লোকবল থাকলেও রক্তের টাইপিং, টিস্যু টাইপিং-ক্রসম্যাচ যন্ত্রপাতি নেই। অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে কোনো একটা গ্যাপ থাকলে সেটি আর সম্ভব হয় না। যেমন—ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চেষ্টা করেও পিছিয়ে যেতে হয়েছে।’
দেশের দু-একটি হাসপাতালে শল্যচিকিৎসকরা আড়াই লাখ টাকায় কিডনি প্রতিস্থাপন করে দিলেও এর সঙ্গে ওষুধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ডায়ালিসিস মিলিয়ে একজন রোগীর ১০ লাখ টাকারও বেশি খরচ হয়। বেসরকারি উন্নত হাসপাতালগুলোতে এই খরচ কয়েক গুণ বেশি।
ডা. মো. শওকত আলম বলেন, ‘আমাদের এখানে অপারেশন বা কিডনি প্রতিস্থাপন খরচ একদম ফ্রি। প্রতিস্থাপন-পরবর্তী তিন মাস রোগীরা বিনামূল্যে কেবিনে বা ওয়ার্ডে থাকে। এই সময়ে তারা ফ্রি ডায়ালিসিস পায়। রোগীর খরচ হয় শুধু কিডনি দাতা ও গ্রহীতার টিস্যু টাইপিং-ক্রসম্যাচ, এসব পরীক্ষা বাইরের হাসপাতাল থেকে করতে হয়। পরীক্ষাগুলো করতে হয় একাধিকবার।’
কিডনিবিষয়ক বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কিডনি অ্যাওয়্যারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটির (ক্যাম্পস) প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ বলেন, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি প্রদাহ (নেফ্রাইটিস) ও স্থূলতা কিডনি রোগের প্রধান কারণ। এ ছাড়া অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, ব্যথানাশক ওষুধের অতিরিক্ত ব্যবহার, জন্মগত ও বংশগত কিডনি রোগ, মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ ও পাথুরে রোগীরাও কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। শহর ও গ্রামাঞ্চলে সমানভাবে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।
একাই ১,৮০০ কিডনি প্রতিস্থাপনের রেকর্ড
দেশে সবচেয়ে বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম। আগামী শুক্রবার এক হাজার ৮০০ কিডনি প্রতিস্থাপনের রেকর্ড গড়তে যাচ্ছেন তিনি।
স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত এই চিকিৎসক কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এর কারণ অঙ্গ প্রতিস্থাপনে দক্ষ জনবল তৈরি করা যায়নি, ওষুধের খরচ অনেক বেশি, আইনি জটিলতা, সরকারের অর্থ বরাদ্দ নেই এবং ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টের দিকে মানুষের আগ্রহ তৈরি করা যায়নি। এ ক্ষেত্রে ক্যাডাভেরিক অঙ্গদান ও প্রতিস্থাপন কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে ধর্মীয়, আইনি ও সমাজের বিশিষ্টজনদের এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে কিডনি প্রতিস্থাপনে সফলতা অন্যান্য দেশের কাছাকাছি রয়েছে। কিন্তু সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও নিয়মিত ওষুধ না পেয়ে রোগীরা মারা যায়।’
গবেষণায় দেখা যায়, কিডনি প্রতিস্থাপনের এক বছরে ৯৬ শতাংশ রোগী ভালো থাকছে, তিন বছরে পর সুস্থ থাকছে ৮৫ শতাংশ, পাঁচ বছরে ৭৫ এবং ১০ বছরে অর্ধেক রোগী মারা যায় বিভিন্ন সংক্রমণের কারণে। অথচ তাদের কিডনি ঠিকমতো কাজ করছিল।
ডা. কামরুল ইসলাম বলেন, কিডনি প্রতিস্থাপনের পর রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এতটাই কমে যায় যে একটা শিশুর মতো তাঁকে যত্ন করতে হয়। সামান্য ইনফেকশন হলেও ক্ষতি হয়।