দেশে সংখ্যালঘু শিক্ষকদের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন, সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা বন্ধের জন্য অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানবিক উন্নয়ন জরুরি। গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে শিক্ষক নির্যাতন ও হত্যার প্রতিবাদে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজিত প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশে শিল্পী, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা এ কথা বলেন।
এ ছাড়া এদিন সাভারে প্রভাষক উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে হত্যা এবং নড়াইলে অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে সারা দেশে বিভাগীয় শহর, জেলা শহর ও উপজেলা শহরে সমাবেশ, পদযাত্রা, মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এসব সমাবেশ ও মানববন্ধনে বক্তারা শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছেন।
বিজ্ঞাপন
শাহবাগে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি বদিউল আলম চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশে বক্তারা বলেন, মানবিক উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে এই যে দেশের পদ্মা সেতু, মেট্রো রেলসহ যত উন্নয়ন হচ্ছে এবং বিদেশে দেশের যে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে তা নিমেষেই নষ্ট হয়ে যাবে। দেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় এবং নৈতিক অবক্ষয় ও সাম্প্রদায়িকতা বন্ধে প্রয়োজন মানবিক উন্নয়ন।
সমাবেশে বক্তব্য দেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এম আকাশ, ডক্টরস অ্যান্ড হেলথ সভাপতি ডা. এম এইচ ফারুকী, শিক্ষাবিদ মমতাজ লতিফ, প্রজন্ম একাত্তরের সাধারণ সম্পাদক আসিফ মুনির, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি নুর মোহাম্মদ তালুকদার, কবি কামরুজ্জামান, উদীচীর সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে, কেন্দ্রীয় খেলাঘরের সাধারণ সম্পাদক দোলন সাহা, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সদস্য খালেদা ইয়াসমিন কনাসহ অনেকে।
রাজশাহী নগরীর সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় মানববন্ধনের আয়োজন করে বাংলাদেশ শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের রাজশাহী জেলা ও মহানগর কমিটি। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের জেলা সভাপতি অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশা। কর্মসূচিতে বিভিন্ন কলেজের শিক্ষকরা অংশ নেন। বক্তারা বলেন, একজন অধ্যক্ষকে পুলিশের সামনেই জুতার মালা পরানো হয়েছে। আবার একজন ছাত্র শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করেছে। অত্যন্ত ন্যক্কারজনক এ ধরনের ঘটনা কেন ঘটছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। মানুষ গড়ার কারিগরদের এমন অবস্থা হলে একটা জাতি কখনো এগিয়ে যেতে পারবে না। তাই জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত সময়ের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তা না হলে শিক্ষকরা লাঞ্ছিত হতেই থাকবেন।
নড়াইলের ডিসি-এসপির শাস্তিসহ অপসারণ দাবি
খুলনা প্রেস ক্লাবে গতকাল দুপুর ১টার দিকে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে খুলনার সম্মিলিত নাগরিক উদ্যোগ। এতে নড়াইলে মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে লাঞ্ছনার ঘটনায় ব্যর্থতার জন্য নড়াইল জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের অপসারণসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দাবি জানানো হয়েছে। খুলনার সম্মিলিত নাগরিক উদ্যোগের নেতারা বলেছেন, কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এবং দুই শতাধিক পুলিশের সামনে জুতার মালা পরিয়ে শিক্ষককে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। এতে তাদের দায়িত্বে অবহেলার পরিচয় মিলেছে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বিএমএর সভাপতি ডা. শেখ বাহারুল আলম। তিনি বলেন, ‘শিক্ষক লাঞ্ছনা এটিই প্রথম নয়, এর আগে মৌলবাদীদের হাতে শিক্ষকের লাঞ্ছনা ও নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হুমায়ুন আজাদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউনুস, এস তাহের ও রেজাউল করিমরা লাঞ্ছনার শিকার হন। কিন্তু সম্প্রতি দেশে যা শুরু হয়েছে, তার আগ্রাসন ও ভয়াবহতা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভয়ংকর। ’ লিখিত বক্তব্যে তিনি আরো বলেন, ‘সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষকরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে অনেক শিক্ষককে নিগৃহীত, লাঞ্ছিত ও অপমান করা হয়েছে, তা একান্তই অনভিপ্রেত। অযৌক্তিক অভিযোগ তুলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান রতন সিদ্দিকী ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফাহমিদা হকের বাসায় মৌলবাদীরা আক্রমণ চালায়। সাভারের আশুলিয়ার শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে তাঁর নিজের ছাত্র যেভাবে হত্যা করেছে তা বীভৎস ও ভয়ংকর। ’
শিক্ষকদের নিরাপত্তায় নতুন আইন প্রণয়নের দাবি
দেশব্যাপী শিক্ষক হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদ, শিক্ষকদের নিরাপত্তায় নতুন আইন প্রণয়ন এবং ঈদের আগে শতভাগ বোনাসসহ চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশন, কুড়িগ্রাম জেলা শাখা। গতকাল শনিবার সকালে কুড়িগ্রাম প্রেস ক্লাবের সৈয়দ শামসুল হক মিলনায়তনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করে শোনান আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশনের কুড়িগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি মো. রুহুল আমিন।
সংবাদ সম্মেলনে আট দফা দাবি তুলে ধরেন শিক্ষক নেতারা। দাবিগুলো হচ্ছে চাকরির বয়সসীমা ৬৫ বছর করা, শতভাগ বোনাসসহ শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ঘোষণা, গ্রাম ও শহরের প্রতিষ্ঠানে একই ধরনের শিক্ষাসামগ্রীসহ ডিজিটাল ল্যাব চালু, ম্যানেজিং কমিটিকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও প্রভাবমুক্তকরণ, পেনশন প্রাপ্তিতে অযথা হয়রানি বন্ধ, নিখুঁত যাচাই-বাছাই করে নন-এমপিও প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের এমপিওভুক্তকরণ এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠদানপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে একাডেমিক স্বীকৃতি প্রদানে অযথা জটিলতা করা, শিক্ষকদের নিরাপত্তা প্রদানে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা এবং ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা শিশু শ্রেণি থেকে সব শ্রেণিতে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
সংসদে ৬০টি সংরক্ষিত আসনের দাবি হিন্দু মহাজোটের
হিন্দু সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব রক্ষায় জাতীয় সংসদে ৬০টি সংরক্ষিত আসন ও পৃথক নির্বাচনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে এবং একটি সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোট নামের একটি সংগঠন। গতকাল সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানানো হয়।
নড়াইলে কলেজ অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা, সাভারে কলেজ শিক্ষক হত্যা, মিথ্যা অজুহাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হিন্দুদের বিরুদ্ধে মামলা, হামলা, জমি দখল, মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুরের প্রতিবাদ ও দোষীদের শাস্তির দাবিতে এবং গত ছয় মাসে হিন্দু নির্যাতনের রিপোর্ট পেশ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক। উপস্থিত ছিলেন হিন্দু মহাজোটের নির্বাহী সভাপতি দীনবন্ধু রায়, সিনিয়র সহসভাপতি প্রদীপ কুমার পাল প্রমুখ।
গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক বলেন, এ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় স্বস্তিতে নেই। প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো স্থানে ঘটছে হৃদয়বিদারক ঘটনা। হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, মঠ ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, হত্যা, হত্যা প্রচেষ্টা, জমি দখল, দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ নানা নির্যাতন অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এর মধ্যে নতুন উপসর্গ হিন্দু শিক্ষকদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত করতে অভিনব কৌশল। গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক আরো বলেন, ‘আজ আপনাদের মাধ্যমে সরকারকে বলতে চাই, সরকারি দলের নেতাকর্মীদের ইন্ধনেই বারবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জীবনে বিভীষিকা নেমে এসেছে। সে কারণে এই সরকারের ওপর হিন্দু সম্প্রদায় আর আস্থা রাখতে পারছে না। শেষ ভরসা হিসেবে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় অপনাদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহবান জানাচ্ছে। ’
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা। ]