<p>সরকারি-বেসরকারি নানা পদক্ষেপের কারণে ২০০৮ সালের চেয়ে দেশে ম্যালেরিয়া সংক্রমণ ৯৩ শতাংশ এবং মৃত্যু ৯৪ শতাংশ কমে এসেছে। তবে বিনিয়োগ ও কার্যক্রম আরো জোরালো না করলে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে ম্যালেরিয়ামুক্ত করা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে চলমান করোনা মহামারি। এতে অনেক কাজেই মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে। যদিও তা কাটিয়ে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে কাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। গতকাল শনিবার সরকারের জাতীয় ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি, কালের কণ্ঠ ও ব্র্যাকের যৌথ আয়োজনে এক গোলটেবিল আলোচনায় বিশেষজ্ঞ আলোচকরা এ অভিমত তুলে ধরেন।</p> <p>কালের কণ্ঠ সম্পাদক ও ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া লিমিটেডের পরিচালক ইমদাদুল হক মিলনের সঞ্চালনায় এই গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন ইউজিসি অধ্যাপক, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক (সচিব পদমর্যাদা) ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ।  সহ-আয়োজক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে স্বাগত বক্তব্য দেন ব্র্যাকের পরিচালক (কমিউনিকেবল ডিজিজ ও ওয়াস কর্মসূচি) ড. আকরামুল ইসলাম।</p> <p>আরো আলোচনা করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ, কীটতত্ত্ববিদ ও বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মাহবুবার রহমান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা, বর্তমান অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা, বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের মহাসচিব ও মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম, কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার, আইসিডিডিআরবির সহযোগী বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম, ব্র্যাকের ম্যালেরিয়া কার্যক্রমের প্রধান ডা. শায়েলা ইসলাম ও কক্সবাজারের বেসরকারি সংস্থা একলাবের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ তারিকুল ইসলাম। গোলটেবিল আলোচনায় ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ডেপুটি প্রগ্রাম ম্যানেজার ডা. আফসানা আলমগীর খান।</p> <p>ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘চলমান করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে পার্বত্যাঞ্চলে মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। যাঁরা জুম চাষি তাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন। তাঁদের পাশাপাশি ওই অঞ্চলে বসবাসকারী প্রান্তিক মানুষও আক্রান্ত হচ্ছে, মারাও যাচ্ছে। ফলে এই পরিস্থিতি আমরা কিভাবে মোকাবেলা করব, সেটা নতুন করে ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতা সবচেয়ে বড় অস্ত্র এবং জরুরি বিষয়। মানুষ যত বেশি সচেতন হবে, তত আমরা রোগমুক্ত হব এবং রোগকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারব।’</p> <p>অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘ম্যালেরিয়া নির্মূল না হলেও নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন নয়। এটা প্রায় নিয়ন্ত্রণে চলেও এসেছে। তবে করোনার মধ্যে একটু ধাক্কা খেয়েছে। এটা শুধু আমাদের দেশেই নয়, বরং সারা পৃথিবীতেই এমনটা হচ্ছে। তবে আমরা যদি সম্মিলিতভাবে কাজ করতে পারি তাহলে আশা করি, ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের যে লক্ষ্য আছে, সেটা পূরণ করতে পারব। করোনার কারণে ম্যালেরিয়ার কথা আমরা ভুলতেই বসেছিলাম। আসলে এটা ছিল মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। সবাই কিন্তু আমরা এখন করোনা নিয়েই ব্যস্ত। অনেক হাসপাতালে করোনার জন্য অন্য সেবাও ব্যাহত হচ্ছে। তবে এত কিছুর মধ্যেও ম্যালেরিয়া নির্মূলে আমাদের দেশে কিন্তু অন্য অনেক দেশের চেয়ে অনেক কাজ হচ্ছে।’</p> <p>অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ বলেন, ‘আমরা সবাই করোনায় মনোযোগ দিচ্ছি। শুধু এটাতে মনোযোগ দিতে গিয়ে ম্যালেরিয়া বা অন্য রোগের দিকে নজর কমে যাচ্ছে। আমরা যদি শুধু কভিড নিয়ে চিন্তা করি তাহলে হবে না। প্রতিটি রোগের ক্ষেত্রেই আমাদের অ্যাডাপটেশন লাগবে। বাংলাদেশের অনেক ম্যালেরিয়া রোগী এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যাতায়াত করে। এই ভ্রমণ করার ফলে নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে ম্যালেরিয়া। এ ক্ষেত্রে আমাদের কমিউনিটি সিস্টেমকে কাজে লাগাতে হবে।’</p> <p>অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, ম্যালেরিয়া সমস্যা অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে কিছু জেলায় একেবারে নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ম্যালেরিয়ামুক্ত দেশে পরিণত করতে হবে, ফলে সেই রোডম্যাপের মাধ্যমেই কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে গ্লোবাল ফান্ড। কারণ এই ফান্ড যদি সংকটে পড়ে তখন কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। করোনা পরিস্থিতিতে সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। নানা রকমের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মাধ্যমেই ম্যালেরিয়া নির্মূলর কাজ অব্যাহত রাখা হয়েছে।</p> <p>অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ১৯৪৭ সাল থেকে এই অঞ্চলে ম্যালেরিয়া বিস্তৃতি বাড়ে। আশির দশকে দেশে ম্যালেরিয়া রোগী ছিল ৩০ হাজারের মতো। ১৯৯১ সালে এসে রোগীর সংখ্যা ৬৩ হাজার পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়। ১৯৯৪ সালে এক লাখ ৫৪ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়। পরবর্তী সময়ে সরকার ম্যালেরিয়া নির্মূলে পদক্ষেপ গ্রহণ করায় রোগীর সংখ্যা কমতে থাকে। করোনার জন্য ম্যালেরিয়া নির্মূলের কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে ম্যালেরিয়া নির্মূলের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।</p> <p>ড. মো. আকরামুল ইসলাম বলেন, ‘ব্র্যাক দীর্ঘদিন ধরে সরকারের সঙ্গে কাজ করছে। ম্যালেরিয়া কিন্তু এখন আর জাতীয় সমস্যা নয়। ১৩টি জেলায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ থাকলেও এটি একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা দিচ্ছে, যেখানে স্বাস্থ্যসেবা অপ্রতুল ও একেবারে সীমান্ত এলাকা ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রতিবছরই ম্যালেরিয়া সংক্রমণ সংকুচিত হচ্ছে। এখানে আমাদের কিছু বাধা আছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা, আবার অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন। পাশাপাশি সীমান্ত এলাকায় প্রকোপ বেশি হওয়ায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়। পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়েরও সমন্বয় দরকার।’</p> <p>ডা. আফসানা আলমগীর খান তথ্য তুলে ধরে জানান, ২০০৮ সালের চেয়ে ৯৩ শতাংশ ম্যালেরিয়া সংক্রমণ কমেছে। ২০২০ সালে ছয় হাজার ১৩০ জন ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছিল, যা ২০০৮ সালে ছিল ৮৪ হাজার ৬৯০ জন। ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত চার হাজার ৩৫ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু কমেছে ৯৪ শতাংশ। ২০২০ সালে ৯ জনের মৃত্যু হয়। ২০০৮ সালে ছিল ১৫৪ জন।  ২০২১-এর ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। প্রান্তিক পর্যায়ে ৮৫ শতাংশ রোগীর ম্যালেরিয়া নির্ণয় করা হয়। এর মধ্যে সিভিয়ার ম্যালেরিয়া ছিল মাত্র ১.৫ শতাংশ। ২০০৮ সালে তিন হাজার ৪২ জন সিভিয়ার ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়, যা ২০২০ সালে এসে মাত্র ৯২ জনে দাঁড়ায়।</p> <p> </p>