<p>সরাসরি কিলিং মিশনে ছিলেন ৯ জন। হামলার নেতৃত্ব দেন ‘রগচটা রউফ’। মারা যাওয়ার আগে তাকবীর বলে গিয়েছিলেন যাঁরা হামলা করেছিলেন তাঁদের নামধাম। বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক তাকবীর ইসলাম খুন হয়েছেন দুই মাস ছুঁই ছুঁই। এত দিনেও পুলিশ ওই মামলার কোনো আসামিকে ধরতে পারেনি। উল্টো পুলিশ বলছে, আসামিদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তাঁরা দেশে নেই। তবে কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধান বলছে, তাকবীর হত্যায় অংশ নেওয়া ৯ সদস্যের খুুুনির দল এখন কক্সবাজারে রয়েছেন প্রমোদভ্রমণে! গত ২ মে আব্দুর রউফ তাঁর দলবল নিয়ে সৈকতভ্রমণে যান। গতকাল শনিবার এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাঁরা সমুদ্রের পাশে কলাতলী এলাকার একটি রিসোর্টে অবকাশযাপনে আছেন।</p> <p>কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রউফ পুরো এপ্রিল মাস ছিলেন তাঁর নিজ গ্রাম বগুড়ার ধুনটের বিলচাপড়ি গ্রামে। বিলচাপড়ি গ্রামটি পাশের উপজেলা শাজাহানপুর লাগোয়া। শাজাহানপুরের শৈলধুকরী গ্রামে রউফের খালার বাড়ি। তাকবীর হত্যায় অংশ নেওয়া আরো আটজন সহযোগী নিয়ে রউফ প্রতি রাতে ওই বাড়িতে অবস্থান করতেন। প্রতিদিনই তিনটি মোটরসাইকেল নিয়ে ধুনট উপজেলা সদরে এসে খুনির দল মহড়া দিত বলে জানিয়েছে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী। তাদের ভাষ্য, ‘রগচটা রউফ’ পুলিশকে কখনো পরোয়া করেন না। কারণ বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনু ও দপ্তর সম্পাদক আল রাজি জুয়েলসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে তাঁর রয়েছে মধুর সম্পর্ক। উল্টো জেলা ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর তাঁর আস্থাভাজন নেতাদের যোগসাজশে ক্ষমতাসীন দলের অন্য অঙ্গসংগঠনে ঢোকারও চেষ্টা ছিল তাঁর।</p> <p>তবে ধুনট থানার ওসি কৃপা সিন্ধু বালা জানান, রউফের অবস্থান সম্পর্কে তাঁর কাছে কোনো তথ্য  নেই। এমনকি খুনির দল আদালত থেকে আগাম জামিন নিয়েছেন কি না, সেটিও তাঁর কাছে অজানা।</p> <p>অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, সুচতুর ও ঠাণ্ডা মাথার খুনি রউফ প্রথমে চেষ্টা করেন এই হত্যা মামলায় যাতে তাঁর নাম কোনোভাবেই না আসে। এ কারণে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনুকে দিয়ে জেলার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে ফোন করান। এতে ব্যর্থ হন রউফ। মামলায় প্রধান আসামি হিসেবে নাম ওঠার পর এখন তিনি নতুন চাতুরীর আশ্রয় নিয়েছেন। চেষ্টা করছেন অভিযোগপত্রে প্রত্যক্ষ খুনি না হয়ে হুকুমের আসামি হওয়া যায় কিভাবে? জানা গেছে, এরই মধ্যে এই বিষয়টি নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আল রাজি জুয়েলের সহযোগিতায় বগুড়া আদালতের বেশ কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবীর সঙ্গে কথা চলছে।</p> <p>এ ব্যাপারে আল রাজি জুয়েল বলেন, ‘আমি যখন ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছিলাম তখন রউফ আমার একজন কর্মী ছিলেন। হত্যা মামলা হওয়ার পর থেকে তাঁর সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই।’</p> <p>জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনু বলেন, ‘ছাত্রলীগের একজন নেতা হিসেবে রউফ আমার সহযোগিতা পেয়েছে। কিন্তু সংগঠন থেকে বহিষ্কৃত হওয়া এবং হত্যা মামলার আসামি হওয়ার পর আমার কাছে ভিড়তে পারেনি। আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলবে।’</p> <p>এদিকে রউফের নামে করা হত্যা মামলাকে মিথ্যা দাবি করে পোস্টারও সাঁটানো হয়েছে শহরের বেশ কয়েকটি স্থানে। রাতের আঁধারে বহিষ্কৃৃত এবং খুনের অভিযোগে পলাতক এক নেতার নামে কারা এসব পোস্টার লাগাল, তা বলতে পারছেন না পুলিশ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। তবে রউফকে রক্ষায় জেলা আওয়ামী লীগের একটি পক্ষের যে ইন্ধন রয়েছে, সেটা নিশ্চিত।</p> <p>পুলিশের রেকর্ড ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, গত ১১ মার্চ সন্ধ্যায় বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় ছাত্রলীগ নেতা তাকবীর হত্যার মিশনে রউফ সরাসরি নেতৃত্ব দেন। আর এই খুনটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত। বেশ কয়েকটি এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, মারা যাওয়ার আগে তাকবীরের জবানবন্দি, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং ১৬৪ ধারার জবানবন্দি সব কিছুই রউফের বিপক্ষে রয়েছে।</p> <p>এদিকে চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় আল-আমিন (২৪) নামের যে যুবককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে জবানবন্দি নিয়েছে তাঁর নাম মামলার এজাহারেই নেই। অভিযোগ উঠেছে, এজাহারভুক্ত আসামিকে গ্রেপ্তার না করে মামলার বাইরের একজনকে ধরে জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। তাকবীরের বাবা জহুরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, আল-আমিনের নাম এজাহারে না থাকলেও তাঁকে গ্রেপ্তার ও জবানবন্দির বিষয়টি সন্দেহজনক। </p> <p>গত ১৮ মার্চ আল-আমিন হত্যার দায় স্বীকার করে অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ শাহরিয়ার তারিকের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পুলিশ জানিয়েছে, সিসিটিভি ফুটেজে শনাক্ত করার পর তাঁকে কাহালু থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।</p> <p>আল-আমিন পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ১১ মার্চ সন্ধ্যায় রউফসহ অন্যরা আজিজুল হক কলেজের পাশে ওয়াপদা গেটে জড়ো হয়। এরপর ২৫-৩০ জন মিলে ১০টি মোটরসাইকেলে করে সাতমাথায় যায়। খুনের প্রস্তুতি হিসেবে সবার হাতেই লোহার রড, পাইপ ও ধারালো অস্ত্র ছিল। এরপর সাতমাথায় আগে থেকে বসে থাকা তাকবীর ও তাঁর সহযোগীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালানোর নির্দেশ দেন রউফ। এ সময় চাপাতি দিয়ে তাকবীরকে প্রথম কোপ দেন রউফ। পরে রক্তমাখা চাপাতিটি সরিয়ে ফেলার জন্য রউফ আল-আমিনকে দেন। পরে তাঁরা ফের কলেজে ফিরে আসেন।</p> <p>বগুড়া শহরের মালতিনগর এলাকার বাসিন্দা তাকবীর ইসলাম দলের সভাপতি পদের প্রার্থিতার দ্বন্দ্বে ১১ মার্চ প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হয়ে ১৬ মার্চ মারা যান। ঘটনার পর বগুড়া আজিজুল হক কলেজ শাখার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রউফ (সদ্য বহিষ্কৃত), তাঁর সহযোগী জাহিদ, আনোয়ার, তারেকসহ একাধিক জনকে অভিযুক্ত করে মামলা করা হয়।</p> <p>মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ও সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আব্দুল মালেক বলেন, ‘তাকবীর হত্যা মামলাটির তদন্ত শেষ পর্যায়ে। মামলার ১ নম্বর আসামি আব্দুর রউফের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা তদন্তে পাওয়া গেছে। শিগগিরই মামলাটির অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হবে।’ আসামিরা গ্রেপ্তার না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ঘটনার পরপরই রউফ পালিয়ে ঢাকা চলে যান। এরপর ২৫ মার্চ উচ্চ আদালত থেকে ছয় সপ্তাহের জন্য আগাম জামিন নিয়েছেন বলে শুনেছি। তাঁর সঙ্গীরাও একই কাজ করেছেন। এ কারণে তাঁদের গ্রেপ্তার করা যায়নি। সম্ভবত আসামিরা দেশে নেই।’</p> <p>তাকবীরের মা আফরোজা ইসলাম বলেন, ‘বিচার নিয়ে সংশয়ে আছি। ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই মামলাটি আপস করতে হুমকি দিচ্ছে। আবার পুলিশের অবহেলার কারণে মূল আসামিসহ অন্যরাও গ্রেপ্তার হচ্ছে না।’</p> <p>তাকবীরের বাবা জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ছেলেকে প্রকাশ্যে খুন করা হলো। যেভাবে মামলাটি নিয়ে চক্রান্ত চলছে, তাতে আমরা বিচার পাব কি না যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।’</p> <p>তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আব্দুল মালেক বলেন, ‘এটি প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ড। অনেক প্রত্যক্ষদর্শী রয়েছে। একজন আসামি জবানবন্দি দিয়েছেন। হত্যার শিকার ব্যক্তিও মৃত্যুর আগে সাক্ষ্য দিয়েছেন। মূল আসামি রউফই হবে। অন্যরাও থাকবে সহযোগী হিসেবে।’</p> <p>বগুড়া সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘রউফকে ধরতে পুলিশের একাধিক দল শুরু থেকেই মাঠে আছে। শিগগিরই তাঁর নামে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।’</p>