উন্নয়নকাজের ইট, কাঠ, বালু রাখা হয়েছে মাঠে। ছবিটি বনানী মাঠের। ছবি : কালের কণ্ঠ
আবরার, সবে দিয়েছে ৯ বছরে পা। বয়সটা তার দুরন্তপনার। রাজধানীর কল্যাণপুর মেইন রোডের ভাড়া বাসার একান্নবর্তী পরিবারে এই শিশুর বেড়ে ওঠা। বাসার আশপাশে খেলার মাঠ না থাকায় অনেকটাই ঘরকুনো আবরার।
বিজ্ঞাপন
ওই ভবনের ভিন্ন ভিন্ন ফ্ল্যাটে থাকে আবরারের চাচাতো ও ফুফাতো ভাই-বোনের পরিবারও। সব মিলিয়ে ওই ভবনে আছে ছয়টি শিশু। তারা সবাই বাসার ভেতরেই খেলাধুলায় মেতে থাকে। কেউ ক্যারম, কেউ লুডু, আবার কেউ দাবার ছকে বন্দি। অনেকে থাকে মোবাইল গেমে বুঁদ। মাঠ না থাকায় নিয়মিত খেলাধুলা করতে না পেরে শিশুরা একদিকে যেমন স্থূলকায় হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তাদের মোবাইল ফোন তথা ইন্টারনেট আসক্তিও বাড়ছে।
আবরারের বাবা আশফাকুর রহমান বলেন, ৯ মাস ধরে স্কুল বন্ধ। স্কুল চালু থাকলে ছুটির পরে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ খেলাধুলা করতে পারে, এখন সেটাও হচ্ছে না। ফলে ঘরের মধ্যেই অলস সময় কাটছে। চিকিৎসকরা বারবার পরামর্শ দিচ্ছেন, শিশুদের বাইরে নিয়ে দৌড়াদৌড়িতে ব্যস্ত রাখতে হবে, খেলাধুলা করাতে হবে। তবে এই নগরে সেই সুযোগ কোথায়?
গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে, কোনো এলাকায় প্রতি পাঁচ হাজার মানুষের জন্য একটি করে খেলার মাঠ প্রয়োজন। যে মাঠের আকার হবে এক একরের। সে ক্ষেত্রে ঢাকার আড়াই কোটি মানুষের জন্য মাঠের প্রয়োজন প্রায় পাঁচ হাজার।
২০১৯ সালে করা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সবশেষ জরিপ ঘেঁটে দেখা যায়, বছরখানেক আগে ঢাকায় মাঠের সংখ্যা ছিল ২৩০। এর মধ্যে ১৪০টি প্রাতিষ্ঠানিক মাঠ, যেগুলো ওই প্রতিষ্ঠানের কম্পাউন্ডের ভেতরে অবস্থিত। অর্ধশতাধিক জায়গা ছিল ব্যক্তিমালিকাধীন, ওই খোলা জায়গায় শিশুরা মাঠ হিসেবে ব্যবহার করে খেলত। পরে সেসব জায়গায় ওঠে অট্টালিকা। তবে ৪০টির মতো মাঠ ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। এর মধ্যে আবার ১৬টি মাঠ দখল হয়ে গেছে। ফলে এখন রাজধানীতে উন্মুক্ত মাঠ আছে মাত্র ২৪টি। এর মধ্যেও কিছু খেলার মাঠ আবার সংস্কার করা হয়েছে। ফলে মাঠের সৌন্দর্য বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু সেসব মাঠে প্রবেশের সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। এদিকে ২০০০ সালের এক জরিপে দেখা যায়, তখন ঢাকা শহরে খেলার মাঠ ছিল ১৫০টি। যদিও ঢাকার মাঠ নিয়ে সরকারি কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন এলাকার ডিজাইনে সেই এলাকার জনসংখ্যাকে মাথায় রেখে খেলার মাঠের পরিকল্পনা করা উচিত সিটি করপোরেশনের। এ ক্ষেত্রে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে পাঁচ বছরে যদি একটি করে খেলার মাঠ করার চিন্তা করা হয় তাহলে বছরে আরো ১২৯টি নতুন খেলার মাঠ পাওয়া যাবে। সদিচ্ছা থাকলে জায়গা কিনেও এটা করা যায়।
ঢাকার দুই সিটি মিলিয়ে খেলার মাঠের সংখ্যা ১৬টি। তার মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ১০টি এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ছয়টি মাঠ রয়েছে। তবে এই মাঠগুলোতে খেলার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের মাঠে গিয়ে দেখা যায়, বিকেলে খেলতে এসেছে কলেজছাত্র সাব্বির ও তার ছয় বন্ধু। তবে মাঠের আকার ছোট হওয়ায় একসঙ্গে অনেকের জায়গা হয় না সেখানে। ফলে সাব্বির এবং তার বন্ধুরা খেলার সুযোগ পায়নি। এ ব্যাপারে সাব্বির বলে, ‘পাশের বিহারি ক্যাম্প থেকে অনেক ছেলেপুলে খেলতে আসে। ফলে আমরা প্রতিদিন সকাল ৬টায় এখানে খেলতে আসি। বিকেলে এলে এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ’
একই এলাকায় ডিএনসিসির আরেকটি মাঠ স্থানীয়ভাবে জাকির হোসেন রোড খেলার মাঠ নামে পরিচিত। স্বল্পদৈর্ঘ্যের মাঠটি লোহার জালে ঘেরা। মাঠের আকার ছোট হওয়ায় সেখানে অনেক শিশু-কিশোরই খেলার সুযোগ পায় না।
মাঠ না থাকায় বাইরে খেলতে যেতে পারে না স্কুল শিক্ষিকা মনিকা শরমিনের দুই সন্তান। লালমাটিয়ায় বসবাসকারী মনিকা বলেন, বাসার কাছাকাছি পর্যাপ্ত মাঠ নেই। ফলে ঘরের মধ্যেই দৌড়াদৌড়ি করে।
বিভিন্ন সময়ে উন্নয়নকাজের জন্য বন্ধ রাখা হয় রাজধানীর মাঠগুলো। মোটামুটি বছর ধরেই চলতে থাকে উন্নয়নকাজ। রাজধানীর উত্তর সিটি করপোরেশনের বনানী মাঠে গিয়ে দেখা যায়, মাঠটিকে মিনি স্টেডিয়াম করার কাজ এক বছর ধরে চলছে। ফলে বিকেলের দিকে শিশুরা এখানে খেলতে এলেও ফাঁকা জায়গাটুকুতে তাদের সবার জায়গা হয় না। করোনার জন্য মাঝে কয়েক মাস কাজ বন্ধ থাকলেও এখন আবার শুরু হয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অন্য তিনটি মাঠ মগবাজারের মধুবাগ, রায়েরবাজার ও সলিমুল্লাহ রোডে অবস্থিত।
এ ব্যাপারে ডিএনসিসির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ড. তারিক বিন ইউসুফ বলেন, ‘উত্তর সিটিতে মাঠ ছয়টি এবং পার্ক ২১টি। তবে অনেক জায়গা পার্ক নামে থাকলেও সেটা আসলে মাঠ। সেখানেও খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া আমাদের এই মাঠ ও পার্কগুলোতে এত দিন উন্নয়নকাজ চলেছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটির কাজ শেষের পথে। আশা করছি, জানুয়ারির মধ্যে ১০টি মাঠ ও পার্ককে আমরা নতুন করে শিশুদের খেলার জন্য খুলে দিতে পারব। ’
ঢাকা দক্ষিণের কয়েকটি মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ মাঠেই উন্নয়নকাজ চলছে। ডিএসসিসি থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ১০টি মাঠের মধ্যে সাতটিতেই উন্নয়নকাজের জন্য বন্ধ আছে। এর মধ্যে সামসাবাদ খেলার মাঠের ২০ শতাংশ, বালুরঘাট মাঠের ৬০ শতাংশ, সাদেক হোসেন মাঠের ৬৫ শতাংশ, দেলোয়ার হোসেন মাঠের ৭৫ শতাংশ, গোলাপবাগ মাঠের ৭৮ শতাংশ এবং বাংলাদেশ মাঠের ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে দক্ষিণের মাত্র তিনটি মাঠ খেলার জন্য উন্মুক্ত আছে। এগুলো হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আলাউদ্দিন পার্ক (বাসাবো মাঠ), জোড়পুকুর মাঠ ও শহীদ আব্দুল আলীম মাঠ।
ঢাকার কলাবাগান মাঠে গিয়ে দেখা যায়, মাঠটিতে উন্নয়নকাজ চলছে। ডিএসসিসির তথ্য মতে, মাঠের উন্নয়নকাজ শেষ হয়েছে ৮০ শতাংশ। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের এক নীতিনির্ধারক বলেন, আধাআধি কাজ হওয়ার পর দুই আড়াই বছর ধরে মাঠটি এভাবেই পড়ে আছে। ফলে কেউ এখানে খেলতে পারছে না।
এ ব্যাপারে ডিএসসিসির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘নগরের প্রতিটি এলাকায় অবশ্যই শিশুদের খেলার জন্য একটি করে মাঠ থাকা উচিত। আমরা এই লক্ষ্যে কাজও করছি। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের মাঠ বা পার্কে যেন কোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি না হয় সেই উদ্যোগ নিয়েছি। পাশাপাশি মাঠ তৈরির জন্য বিভিন্ন সংস্থার যেসব জমি আছে, সেগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। ’
নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ঢাকা শহরে এখন যত লোক বাস করে, তাদের জন্য যেসংখ্যক খেলার মাঠ বা পার্ক দরকার, এখন তার ১ শতাংশেরও কম আছে। শুধু শিশুদের জন্য নয়, বড়দের জন্যও মাঠের দরকার। খাসজমি চিহ্নিত করে এবং খাল ও নদীর পারের জায়গাগুলোকে পাবলিক স্পেস বা গণপরিসর হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এখানে খেলার মাঠও বানানো যায়। ভালো শহর বানাতে হলে অবশ্যই পাবলিক স্পেস দরকার আছে। তিনি আরো বলেন, স্কুল ছুটির পর সেখানের খেলার মাঠ অব্যবহৃত পড়ে থাকে। বিকেলে সেটাকে কমিউনিটিকে ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এই উদ্যোগটা নিতে হবে মেয়র ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে।