ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত করোনার টিকা ‘কোভিশিল্ড’ দ্রুত পাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে সরকার। কিন্তু এই টিকা পাওয়ায় দেরি হবে—সম্প্রতি এমন একটি খবরে হুলুস্থুল শুরু হয়। টিকার সর্বশেষ অবস্থা ও অন্যান্য বিষয় জানতে গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপির মুখোমুখি হয় কালের কণ্ঠ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তৌফিক মারুফ
কালের কণ্ঠ : করোনাভাইরাসের টিকার বিষয়টি এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, এর মধ্যে গত ৪ জানুয়ারি যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল সেটা কেন? আসলেই কি ভারত থেকে বাংলাদেশকে টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল বা আছে?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী : সেদিন সবার মতো আমরা, আমিও সকাল থেকেই হঠাৎ করে অমন একটি অপ্রত্যাশিত খবরে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম। ওই দিন বেশ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কারণ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না, হওয়ার মতো কোনো কারণও ছিল না। সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। তার পরও আমি নিজে এবং অন্যরা বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ শুরু করি। ঘটনাটি কী ঘটেছে জানার চেষ্টা করি। এমনকি আমি নিজে ভারতের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে কথা বলি। তাঁরাও বিষয়টি জানতেন না। পরে খোঁজখবর নিয়ে তাঁদের দিক থেকে জানানো হয়, কোনো সমস্যা হবে না। সেখানে সরকারিভাবে কোনো নিষেধাজ্ঞাই দেওয়া হয়নি।
সেরামের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের একটি বক্তব্য ঘিরে এক ধরনের ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছিল, যার কোনো নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে না। চুক্তি অনুসারেই সব কিছু চলবে। কারণ বাংলাদেশ ও ভারতের দুটি প্রাইভেট কম্পানির মধ্যে চুক্তি হলেও এর অংশীদার হয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ফলে বিষয়টি আর প্রাইভেট থাকেনি। এ ছাড়া ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কও খুবই ইতিবাচক পর্যায়ে রয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে আমাকে জানানো হয়, টিকা পাওয়া নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছুই হয়নি। তার পরে ভারতের বাংলাদেশস্থ দূতাবাস থেকেও বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়। ওই একটি দিন খুবই অস্বস্তির মধ্যে কেটেছে। তবে বেলা শেষে ঠিকই স্বস্তি ফিরে এসেছে।
কালের কণ্ঠ : ওই দিনের ঘটনার মধ্য দিয়ে আপনারা কি কোনো সতর্কবার্তা পেলেন?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী : হ্যাঁ, সেদিনকার ঘটনাটি আমাদেরকে এক ধরনের উপকার করে দিয়েছে। পুরো প্রক্রিয়ায় একটা নতুন গতি এসেছে। এই যেমন ধরুন—ওই দিনই বেক্সিমকো আবেদন করেছে, আমাদের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে ওই দিনই আমদানির অনাপত্তি দিয়ে দিয়েছে। আমরা টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। সব কিছুই দ্রুত সময়ের মধ্যে হয়ে গেল। তবে এ ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতির কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। এসবের মধ্য দিয়ে আগের তুলনায় এক ধরনের বাড়তি সতর্কতাও কাজ করছে।
কালের কণ্ঠ : শুধু সেরাম ও কোভ্যাক্সেই আটকে আছেন কেন, নতুন আরো উৎস কি হাতে রাখা দরকার না?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী : আমরা সেরাম থেকে পাচ্ছি দেড় কোটি মানুষের তিন কোটি ডোজ টিকা, কোভ্যাক্স থেকেও তিন কোটি ২০ লাখ মানুষের জন্য পাচ্ছি ছয় কোটি ৪০ লাখ ডোজ টিকা। সেরাম আর কোভ্যাক্স থেকে এ বছরের মধ্যেই আমরা প্রায় পাঁচ কোটি মানুষকে টিকা দিতে পারব, এখন পর্যন্ত আমাদের চূড়ান্ত প্রস্তুতি অনুযায়ী। এ ছাড়া সামনে আরো টিকা আসবে অন্য সোর্স থেকেও। চীনের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে, ভারতের টিকারও ট্রায়ালের আবেদন আছে। রাশিয়ার সঙ্গে আগে কথা হয়েছিল। প্রাইভেট সেক্টর থেকেও সরকারের সব নিয়ম-নীতি মেনে টিকা আনতে পারবে। কোভ্যাক্স থেকে টিকা পেতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে আমরা ৫০০ কোটি ডলার পেয়েছি। সামনে হয়তো আরো অর্থের জোগান পাব। ফলে টিকার জোগান নিয়ে চিন্তা হওয়ার মতো কারণ আছে বলে মনে হয় না। এসব টাকা দিয়ে টিকা সংগ্রহ, টিকা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য উপকরণ কেনা, আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাপনায় ব্যয় করা হবে।
কালের কণ্ঠ : এই মুহূর্তে আপনি কি বড় কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছেন? থাকলে সেটা কী?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী : আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, কিভাবে কোথা থেকে টিকার জোগান হবে সেটা। সেই চ্যালেঞ্জ ইতিমধ্যে আমরা ওভারকাম করেছি। এখন আমাদের সামনে আরেক বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পরিকল্পনা অনুসারে সুশৃঙ্খলভাবে সব কর্মকৌশল অনুসরণের মাধ্যমে তালিকা ধরে ধরে প্রাপ্য সবার টিকা নিশ্চিত করা। আশা করি, এখন পর্যন্ত আমাদের যে প্রস্তুতি আছে তাতেও আমরা সফল হব ভালোভাবেই। কারণ গাইডলাইন অনুসারেই টিকা পরিবহন, সংরক্ষণ ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা চলমান রয়েছে; কোনো সমস্যা হবে না। এ ছাড়া সামনে যখন যেটা প্রয়োজন হবে তা-ও করা হবে। তবে সবাইকে একটা বিষয় মনে রাখা দরকার যে এই টিকা কিন্তু সবাই পাবে না। ১৮ বছরের নিচে কিংবা গুরুতর অসুস্থ বয়স্ক জনগোষ্ঠী কিংবা গর্ভবতী নারীসহ অনেকেই এই টিকা দিতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে কারা টিকা পাবে, কারা পাবে না, সেটাও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও যখন যে টিকা আসবে সেই টিকার প্রটোকল অনুসারেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কালের কণ্ঠ : টিকা বিষয়ে সর্বশেষ কী অবস্থা?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী : সর্বশেষ বলতে আজ (গতকাল) দেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার আবিষ্কৃত করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন ব্যবহারের বিষয়ে অনুমোদনকারী টেকনিক্যাল কমিটি বৈঠক করে ব্যবহারের চূড়ান্ত অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। এখন আর দেশে ওই টিকা আমদানি এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। এখন শুধু হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় আছি।
কালের কণ্ঠ : দেশে কবে নাগাদ টিকা আসবে, এককথায় কি বলতে পারেন?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী : হিসাব অনুসারে আগের মতোই বলব, জানুয়ারির শেষে বা ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগের মধ্যে সেরাম থেকে টিকা আসবে। বিশেষ করে, চুক্তিতে আছে অনুমোদনের এক মাসের মধ্যেই টিকার প্রথম লট আসবে। ফলে এর ব্যত্যয় ঘটার আর সুযোগ দেখছি না।
মন্তব্য