গোলাম ফারুক পিংকু লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। অ্যাডভোকেট নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন সাধারণ সম্পাদক। এক সংগঠনের ছায়াতলে দুজনের রাজনীতি হলেও সম্পর্কটা তাঁদের দা-কুমড়ো। সাংগঠনিক কোনো সিদ্ধান্তে সভাপতি পিংকু ‘হ্যাঁ’ বললে সাধারণ সম্পাদক নয়ন বলেন ‘না’। এ নিয়ে নেতাকর্মীরা থাকেন ধোঁয়াশায়। তবে মনোনয়ন বাণিজ্য আর রাজনৈতিক ভাগ-বাটোয়ারার মওকা পেলে দুজনই আবার এক ঘাটে জল খান! সভাপতি আর সাধারণ সম্পাদকের এ রকম ‘বিরোধ-সখ্য’র গল্পটা নেতাকর্মী-সমর্থক সবারই জানা।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের ৩ মার্চ পিংকু-নয়ন লক্ষ্মীপুর আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের মাধ্যমে জেলার শীর্ষ দুই পদে বসেন। পরের বছর দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা ৭১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন দেন। এরই মধ্যে ওই কমিটির ছয় নেতা মারাও গেছেন। কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে পেরিয়ে গেছে আরো আড়াই বছর। এর পরও নতুন কমিটি গঠনের তোড়জোড় দৃশ্যমান হয়নি।
শুধু কি জেলা কমিটি, ২০০৩ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে রায়পুর ও রামগতি উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি হয়। রায়পুরের কমিটির সভাপতি তোজ্জাম্মেল হোসেন চৌধুরী দুলালসহ ২৩ জন ও রামগতির সভাপতি গোলাম মাওলা চৌধুরীসহ কমপক্ষে ১৫ জন এরই মধ্যে মারা গেছেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এত বছরেও আর সম্মেলনের বাঁশি বাজেনি। সেই ২০০৪ সালে লক্ষ্মীপুর পৌর, ২০০৫ সালে রামগঞ্জ পৌর, ২০১২ সালে রায়পুর পৌর এবং ২০১৩ সালে রামগতি পৌর আওয়ামী লীগের কমিটি হয়। এর পর থেকে নতুন করে আর আসেনি নতুন নেতৃত্ব।
স্থানীয় বিভিন্ন নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য, এক থেকে দেড় যুগ আগে করা শাখা কমিটিতে স্থির থাকা, ব্যক্তি চেম্বারকেন্দ্রিক রাজনীতি, সভাপতি-সম্পাদকের ছাইচাপা দ্বন্দ্বে একরকম খাবি খাচ্ছে লক্ষ্মীপুর আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ ও কৃষক লীগ নেতাদের একের সঙ্গে অন্যের সমন্বয় নেই।
এদিকে সংগঠনের এসব সংকট নিরসনে আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকালে শহরের একটি কমিউনিটি সেন্টারে জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা ডাকা হয়েছে। সেখানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধান অতিথি হিসেবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।
বর্ধিত সভার আগে হঠাৎ গত সোমবার মধ্যরাত থেকে ফেসবুকে জেলা আওয়ামী লীগের একটি পুরনো চিঠি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়নের সই করা ওই চিঠি দলীয় প্রধানের কাছেও পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য এম এ তাহের ও আবদুল্লাহ আল মামুন (সাবেক এমপি) গত উপজেলা পরিষদ নির্বচনে নৌকার বিরুদ্ধে ভোট করেছেন। দলীয় প্রধানকে অবগত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করা চিঠি গত বছরের ৩ এপ্রিল লেখা হয়। এরপর চিঠির বিষয়টি গোপন রাখা হয়। সেই চিঠিতে নাম থাকা লক্ষ্মীপুরের মেয়র এম এ তাহের এবারও পৌর নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের সাবেক তিন নেতা জানান, স্থানীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ নেতা পিংকু-নয়ন ছাড়াও সদর আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শাহজাহান কামাল ও মেয়র এম এ তাহের লক্ষ্মীপুরে প্রভাব বিস্তার করে আসছেন। বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় নেই। সবার ব্যক্তিগত কার্যালয়ে নিজস্ব বলয় নিয়ে কার্যক্রম চলছে। সিনিয়র নেতাদের মধ্যে মনের মিল না থাকলেও মাঝেমধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঐক্য হয়।
এর মধ্যে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের আলোচিত এমপি কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল অর্থ ও মানবপাচারকাণ্ডে কুয়েতে কারাগারে বন্দি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সদর ও রায়পুরের দুজন ইউপি চেয়ারম্যান জানান, মাঠপর্যায়ে নেতাকর্মীদের মনে বঞ্চনা ও অবমূল্যায়িত হওয়ায় ক্ষোভ-অভিমান রয়েছে। তবে দলের কিছু অতি উৎসাহী নেতাকর্মী সব সময় শীর্ষ নেতাদের ভাইবন্দনায় মুখর থাকেন। এর ঢেউ আছে তৃণমূলের ওয়ার্ড পর্যন্ত।
কমলনগরের এক সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেওয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে জেলার এক নেতা পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছেন। কিন্তু বিতর্কিত এক প্রার্থীর কাছ থেকে বেশি টাকা পেয়ে তারা আমার নাম মনোনয়নের জন্য পাঠায়নি। এখন ঘুমাতে গেলেও কষ্টের এ কথা মনে পড়ে।’
রায়পুরের দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু সালেহ মো. মিন্টু ফরায়েজী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতারা টাকার জন্য শুধু খাই-খাই করছে। তারা ভূমিখেকোদের নাম মনোনয়নের জন্য প্রস্তাব করে। মনোনয়ন বাণিজ্যে তারা অন্ধ হয়ে গেছে।’
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মো. খসরু নোমান রতন বলেন, আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জেলাজুড়ে গত ইউনিয়ন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য করে কয়েক কোটি টাকা কামিয়েছেন।
লক্ষ্মীপুর-৩ (সদর) আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এ কে এম শাহজাহান কামাল বলেন, এখানে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম চলছে। শুধু মেয়র এম এ তাহের কয়েক বছরে কোটি কোটি লুটপাট করেছেন। এখানে প্রকাশ্যে কোনো দরপত্র হয় না, তাঁর ছেলে সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন।
মন্তব্য