<p>‘দ্বিতীয় ভুবন রচনার অধিকার/দিয়েছ আমার হাতে—/এই ভেবে আমি যত খেয়া পারাপার/করেছি গভীর রাতে,/প্রতিবার তরী কান্নায় শুরু হয়/কান্নায় ডোবে জলে,/হাসিমুখে তবু কেন হে বিশ্বময়/তোমার তরণী চলে?’</p> <p>কবিতাটির শিরোনাম ‘অপূর্ণ’। রচয়িতা কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। সহজাত কবিত্বপ্রতিভার নক্ষত্রদীপ্তি নিয়ে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন বাংলা কবিতার আকাশে। অসামান্য প্রকরণ দক্ষতা ও কবি হৃদয়ের মাধুর্যস্পর্শে পাঠকদের বিমোহিত করে আসছিলেন। পঞ্চাশের দশকে রবীন্দ্র প্রভাব থেকে বের করে বাংলা কবিতাকে যাঁরা নতুন সুরে, নতুন ভাবকল্পে আন্দোলিত করার প্রয়াস নিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁদের অগ্রপথিক।</p> <p>‘হাওয়ার ভিতর কার ক্ষমা ঐ কাজ করে যায়’ কিংবা ‘ভগবানের গুপ্তচর মৃত্যু এসে বাঁধুক ঘর/ছন্দে, আমি প্রয়াস নিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁদের অগ্রপথিক।</p> <p>‘হাওয়ার ভিতর কার ক্ষমা ঐ কাজ করে যায়’ কিংবা ‘ভগবানের গুপ্তচর মৃত্যু এসে বাঁধুক ঘর/ছন্দে, আমি কবিতা ছাড়ব না’—কবিতায় এ রকম পঙক্তির পর পঙক্তিতে যেমন ছড়িয়ে দিয়েছেন দার্শনিক বোধ, তেমনি অলৌকিক বাচন ভঙ্গিমা, স্বতন্ত্র ভাষাশৈলী ও নতুন চিন্তাসূত্রের প্রবর্তন করে গেছেন ঐতিহ্যের প্রবহমানতায় বিশ্বাসী এই কবি। নিত্যনতুন শব্দের সন্ধান, অপূর্ব শব্দবিন্যাস তাঁর কবিতার প্রতি আকৃষ্ট করে কবিতামনস্ক পাঠকদের। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যৌবনবাউল’ (১৯৫৯) থেকে সর্বশেষ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘পাহাড়তলির বাস্তুহারা’ পর্যন্ত এই চিত্র জাজ্বল্যমান।</p> <p>এ ছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে রক্তাক্ত ঝরোখা (১৯৬৯), ছৌ-কাবুকির মুখোশ (১৯৭৩), গিলোটিনে আল্পনা (১৯৭৭), দেবীকে স্নানঘরে নগ্ন দেখে (১৯৮৩), মরমী করাত (১৯৯০) ইত্যাদি।</p> <p>শুধু কবিতাই নয়, তাঁর গদ্য-প্রবন্ধের বইগুলোও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে পাঠকের আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে। লিখেছেন বেশ কয়েকটি গদ্যের বই। বিশেষ করে ‘শিল্পীত স্বভাব’ (১৯৬৯), ‘স্থির বিষয়ের দিকে’ (১৯৭৬) গদ্যগ্রন্থ দুটি কার না ভালো লাগে?</p> <p>অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের লেখা ২০টির বেশি কাব্যগ্রন্থ এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি বহু বাংলা ও সাঁওতালী কবিতা ও নাটক ইংরেজি ও জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছেন; জার্মান ও ফরাসি সাহিত্য অনুবাদ করেছেন বাংলায়। বাংলা ও জার্মান সাহিত্যের মেলবন্ধন ঘটানোর এই চেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে গ্যেটে পুরস্কারে ভূষিত করেছে জার্মান সরকার। ১৯৯২ সালে ‘মরমী করাত’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি পেয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। এ ছাড়া রবীন্দ্র পুরস্কার ও আনন্দ পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন।</p> <p>সেই তারুণ্যের দিনগুলোতে কবি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর বন্ধুত্ব। শঙ্খ তাঁকে ডাকতেন ‘বাংলা কবিতার যুবরাজ’ বলে। অনেক পরে, লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন যখন বাংলা কবিতাকে একুশ শতকের দুয়ারে নিয়ে এলো, তার সঙ্গেও নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন এই কবি। কলকাতার তরুণদের সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল সব সময়।</p> <p>১৯৩৩ সালের ৬ অক্টোবর কলকাতায় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের জন্ম। শান্তিনিকেতনে পড়া শেষ করে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে করেন স্নাতকোত্তর। পরে ভারতীয় কবিতার ওপর করেন পিএইচডি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক যুগের বেশি সময় তিনি তুলনামূলক সাহিত্য পড়িয়েছেন। সেই সময় জার্মান সাহিত্যের প্রতি তাঁর আগ্রহ তৈরি হয় এবং অনুবাদ শুরু করেন। একপর্যায়ে হামবোল্ড ফাউন্ডেশনের ফেলোশিপ নিয়ে ১৯৭১ সালে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে যান তিনি। সেখানে অধ্যাপনা শুরু করে জার্মানিতেই স্থায়ী হয়ে যান।</p> <p>চার দশকের বেশি সময় ধরে জার্মানিতে বসবাস করছিলেন পশ্চিমবঙ্গের কবি অলোকরঞ্জন। নিজের কবিতার লাইনের সেই ‘দ্বিতীয় ভুবন রচনা’র অধিকারে তিনি চলে গেলেন প্রথম ভুবন ছেড়ে। গত মঙ্গলবার রাতে হাইডেলবার্গে নিজের বাড়িতে ৮৭ বছর বয়সী এই কবি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বলে স্ত্রী এলিজাবেথ জানিয়েছেন।</p> <p> </p>