<p>হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলায় কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি সরকারি ধান-চাল কেনায় চলছে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। উপজেলা খাদ্য অধিদপ্তর ও কৃষি অফিসের কর্মকর্তাদের ঠেলাঠেলিতে চলছে এ অনিয়ম। সরকারের এই ধান-চাল কেনার তালিকায় নেই অনেক গ্রামের নাম। আবার একই পরিবারের পাঁচ-সাতজনকে দেখানো হয়েছে কৃষক হিসেবে। তালিকার শীর্ষে রয়েছেন চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ তাঁদের আত্মীয়-স্বজনরা। প্রবাসী এবং কৃষি পেশায় নেই এমন অনেকের নামও স্থান পেয়েছে তালিকায়। কৃষক না হলেও কৃষক সেজে টনপ্রতি খাদ্য কর্মকর্তাদের তিন হাজার টাকা উেকাচ দিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে ধান। এ নিয়ে উপজেলাজুড়ে কৃষকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে ক্ষোভ।</p> <p>এদিকে নবীগঞ্জে সরকারি ধান-চাল সংগ্রহে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ওঠায় এই কার্যক্রম বন্ধ করে অভিযোগ তদন্তে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আতাউল গণি ওসমানীকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ধান-চাল সংগ্রহ কমিটির সভাপতি তৌহিদ বিন-হাসান এ কমিটি গঠন করেন।</p> <p>নবীগঞ্জ খাদ্যগুদাম অফিস সূত্রে জানা গেছে, নবীগঞ্জ উপজেলা ও পৌরসভা মিলে এই মৌসুমে ৫৩৮ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহের কথা রয়েছে। প্রায় এক মাস ধরে ধান সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হলেও এ পর্যন্ত কেনা হয়েছে মাত্র ১৭০ মেট্রিক টন। আর ৩৬৮ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহের কাজ বাকি রয়েছে।</p> <p>কিন্তু টনপ্রতি খাদ্যগুদামের কর্মকর্তাদের চাহিদামতো টাকা না দেওয়ায় নানা অজুহাতে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে কৃষকের ধান। অনেক কৃষকের ধান গুদাম এলাকায় মাপজোখের নামে ফেলে রাখা হয়েছে। বিপরীতে সিন্ডিকেট ও প্রভাবশালী নেতাদের মাধ্যমে কেনা হচ্ছে ধান। এতে কৃষকরা বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর ভেস্তে যাচ্ছে সরকারের উদ্যোগ।</p> <p>ক্ষতি কমাতে সরকার কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়। গত ২৬ মে থেকে সরকার প্রতি মন ধান এক হাজার ৪০ টাকা দরে কেনার কার্যক্রম শুরু করে। এটি চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। ধান সংগ্রহ কার্যক্রমের উদ্বোধনের পর নবীগঞ্জের একটি পৌরসভাসহ ১৩টি ইউনিয়নে কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। তবে প্রকৃত কৃষকের নাম না রেখে প্রভাবশালী নেতা, ইউপি সদস্য, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তার জোগসাজশে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নবীগঞ্জ পৌরসভা ও উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নে আলাদা তালিকা করা হয়। যে তালিকার বেশির ভাগই কৃষক নয়।</p> <p>বাজারে প্রতি মন ধান বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। নেতারা সিন্ডিকেট করে কৃষকের কাছ থেকে এই দামে ধান কিনে সরকারি গুদামে সরবরাহ করে মনপ্রতি হাতিয়ে নিচ্ছেন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।</p> <p>করগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছাইম উদ্দিন জানান, তিনি তাঁর ইউনিয়নে উপজেলার সর্বোচ্চ ৫০ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহের বরাদ্দ পেয়েছেন। তাঁর এলাকার উপকৃষি কর্মকর্তা খালেদা খাতুন প্রকৃত কৃষককে বাদ দিয়ে অর্থের বিনিময়ে কৃষক নয় এমন লোকদের তালিকাভুক্ত করেন। পরে তিনিসহ ইউপি সদস্যদের তোপের মুখে প্রকৃত কৃষকদের তালিকাভুক্ত করা হলেও ধান দিতে পারছেন না।</p> <p>কুশি ইউনিয়নের হৈবতপুর গ্রামের আনসার উদ্দিনের ছেলে মিশু মিয়া জানান, তাঁদের এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বসরত সরকারকে তিন হাজার টাকা না দেওয়ায় ধান কেনার তালিকার তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অন্যদিকে বসরত সরকার এ অভিযোগের কথা অস্বীকার করে জানান, তাঁরা স্থানীয় চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের নিয়ে তালিকা করেছেন।</p> <p>তালিকাভুক্ত কৃষক কামাল মিয়া জানান, খাদ্য কর্মকর্তার কথা অনুযায়ী এক সপ্তাহ ধরে তাঁর ধান খাদ্যগুদামে পড়ে আছে। কিন্তু মাপজোখ করা হচ্ছে না। নেওয়াও হচ্ছে না।</p> <p>আনছার মিয়া নামের আরেক কৃষক জানান, কৃষি কর্মকর্তা ও মেম্বারকে টাকা না দেওয়ায় তিনিসহ তিনজনের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়নি। ফলে তাঁরা ধান বিক্রি করতে পারছেন না।</p> <p>এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নবীগঞ্জ উপজেলা খাদ্যগুদামের ইনচার্জ আহসান হাবিব বলেন, ‘এখানে কোনো দুর্নীতি হচ্ছে না। তালিকা মোতাবেক আমরা ধান নিচ্ছি। কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে কৃষি অফিস করেছে। কারো কাছ থেকে আমরা টাকা নিইনি।’</p> <p>নবীগঞ্জ উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক গৌরিপদ বলেন, ‘তালিকা সম্পর্কে নবীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসের কর্মকর্তারাই ভালো বলতে পারবেন। তাঁদের মাধ্যমেই এ তালিকা করা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কৃষক এলে আমরা তাদের ধান সংগ্রহ করি। আবার অনেকে ধান রেখে চলে যায়।’</p> <p>নবীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এ কে এম মাকসুদুল আলম বলেন, ‘আমরা স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সহযোগিতায় কৃষকের তালিকা করেছি। তালিকায় কোনো অনিময় হয়ে থাকলে খতিয়ে দেখব।’</p> <p>নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ধান-চাল সংগ্রহ কমিটির আহ্বায়ক তৌহিদ বিন হাসান বলেন, ‘কৃষকের তালিকায় যদি চেয়ারম্যান-মেম্বারদের নাম এবং তাঁদের আত্মীয়-স্বজনের নাম দেওয়া হয়, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’</p> <p>নবীগঞ্জ ধান-চাল সংগ্রহ কমিটির উপদেষ্টা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল হক চৌধুরী সেলিম বলেন, ‘যদি তালিকায় কোনো প্রবাসীর নাম দেওয়া হয় এবং জনপ্রতিনিধির নাম পাওয়া যায়, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’</p> <p> </p> <p> </p>