<p>প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সংগতি রেখে প্রত্যাশিত হারে দারিদ্র্যের হার কমছে না। গত তিন বছরে দারিদ্র্য কমার গতি অনেকটাই মন্থর। একইভাবে মন্থর হয়েছে অতিদরিদ্র কমার গতিও। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ব্যয় জরিপের চূড়ান্ত ফলাফলে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ফলাফলের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে তিন কোটি ৪৯ লাখ মানুষ। শতাংশের হিসাবে ২১.৮ শতাংশ। আর হতদরিদ্রের হার এখন ১১.৩ শতাংশ বা এক কোটি ৮০ লাখ। এর আগে ২০১৬ সালে বিবিএস যখন প্রাথমিকভাবে খানা আয় ব্যয় জরিপের তথ্য দিয়েছিল, ওই সময় দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪.৩ শতাংশ। আর ২০১০ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩১ শতাংশ। ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত যে হারে দারিদ্র্যের হার কমেছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সেই হারে কমেনি।</p> <p>গতকাল সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিবিএস কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ২০১৬ সালে পরিচালনা করা খানা আয় ব্যয় জরিপের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন খানা আয় ব্যয় জরিপ প্রকল্পের</p> <p>পরিচালক (পিডি) ড. দীপংকর রায়। এ সময় প্রতিবেদনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন বিবিএস মহাপরিচালক ড. কৃষ্ণা গায়েন। উপস্থিত ছিলেন বিবিএস পরিচালক জিয়াউদ্দিন আহমেদ এবং উপপরিচালক এ কে এম আশরাফুল হকসহ অন্যরা।</p> <p>খানা আয় ব্যয় জরিপে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অতিদরিদ্রের হার কমছে তুলনামূলক মন্থর গতিতে। দেশে এখন অতিদরিদ্রের হার ১২.৯ শতাংশে। ২০১০ সালে এর হার ছিল ১৭.৬ শতাংশ। এ হিসাবে ছয় বছরে অতিদারিদ্র্য কমেছে ৪.৭০ শতাংশ হারে। বছরপ্রতি অতিদারিদ্র্য কমেছে গড়ে দশমিক ৭৮ শতাংশ হারে। এর আগে ২০০৫ থেকে ২০১০ এই সময়ে প্রতিবছর গড়ে অতিদারিদ্র্য কমার হার ছিল দেড় শতাংশ।</p> <p>প্রবৃদ্ধি বাড়লেও দারিদ্র্য সে হারে কেন কমছে না—প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, প্রবৃদ্ধি বাড়লেও মানুষের শ্রম আয় না বাড়লে দারিদ্র্যের হার সেই হারে কমবে না। শ্রম আয় বাড়লে সাধারণত দারিদ্র্য কমে আসে। গত কয়েক বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি যে হারে বেড়েছে, শ্রম আয় সেই হারে বাড়েনি। ফলে দারিদ্র্য কমার হার প্রত্যাশার চেয়ে কম।</p> <p>সংবাদ সম্মেলনে বিবিএস মহাপরিচালক কৃষ্ণা গায়েন বলেন, ২০০৫ সালে যখন খানা আয় ব্যয় জরিপটি করা হয়, ওই সময় মোট ১০ হাজার ৮০টি খানা ও ২০১০ সালে ১২ হাজার ২৪০টি খানা নিয়ে জরিপ পরিচালনা করা হয়েছিল। ২০১৬ সালে নমুনা খানার সংখ্যা বাড়িয়ে ৪৬ হাজার ৮০টি করা হয়, যাতে সঠিক তথ্য উঠে আসে। জরিপের চূড়ান্ত ফল অনুযায়ী, দেশের প্রতিটি খানার মাসে গড় আয় ১৫ হাজার ৯৮৮ টাকা। এর আগে ২০১০ সালে খানাপ্রতি গড় আয় ছিল ১১ হাজার ৪৭৯ টাকা। এ সময়ে মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৫৫৩ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৯৪০ টাকায়। আয়ের পাশাপাশি পরিবারপ্রতি ব্যয়ও বেড়েছে। ২০১৬ সালের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, খানাপ্রতি ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা। ২০১০ সালে প্রতিটি খানার আয় ছিল গড়ে ১১ হাজার ২০০ টাকা।</p> <p>অবশ্য মাথাপিছু আয় ব্যয় বাড়লেও খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ কমেছে বলে জানিয়েছে বিবিএস। ২০১০ সালে মাথাপিছু ৪১৬ গ্রাম ভাত গ্রহণ করা হলেও এর পরিমাণ নেমেছে ৩৬৭ গ্রামে। মাথাপিছু ক্যালরি গ্রহণের হার দুই হাজার ২১০ কিলো ক্যালরিতে নেমে এসেছে। ২০১০ সালে মাথাপিছু গড়ে দুই হাজার ৩১৮ কিলো ক্যালরি খাদ্য গ্রহণ করা হতো। তবে মাছ খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। সবজি, মাংস ও ডিম খাওয়ার পরিমাণও বেড়েছে। কমেছে ফল, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য গ্রহণের পরিমাণ। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, স্বাধীনতার পর থেকে টাকা খরচের বড় অংশ খাদ্য কিনতে ব্যয় করা হলেও এবার খাদ্যবহির্ভূত খাতে বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে পরিবারগুলোর গড় অর্থ ব্যয়ের ৪৭.৭ শতাংশ ব্যয় হয়েছে খাদ্য খাতে। এ সময়ে খাদ্যবহির্ভূত খাতে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৫২.৩০ শতাংশ। এর আগে ২০১০ সালে খাদ্য খাতে ৫৪.৮ শতাংশ ও খাদ্যবহির্ভূত খাতে ৪৫.২০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছিল।</p> <p>খানা আয় ব্যয় জরিপে ২০১৬ থেকে দেশের আঞ্চলিক বৈষম্যের কিছুটা উদ্বেগজনক চিত্র পাওয়া গেছে। কুড়িগ্রাম জেলায় দারিদ্র্যের হার এখনো ৭০.৮ শতাংশ। এ ছাড়া বান্দরবান ৬৩.২ শতাংশ, রাঙামাটিতে দারিদ্র্যের হার ৬৪ শতাংশ। তা ছাড়া এ জরিপে নতুন দারিদ্র্যের পকেট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে দিনাজপুর ও মাগুরা। এ দুই জেলায় দারিদ্র্যের হার যথাক্রমে ৬৪.৩ শতাংশ এবং ৫৬.৭ শতাংশ। কিশোরগঞ্জে দারিদ্র্যের হার ৫৩.৫ শতাংশ। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, দেশের সব মানুষের যত আয়, এর মাত্র ১.০১ শতাংশ আয় করে সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষ। ছয় বছর আগেও মোট আয়ের ২ শতাংশ এই শ্রেণির মানুষের দখলে ছিল। অন্যদিকে সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষের আয় মোট আয়ের ৩৮.১৬ শতাংশ। ছয় বছর আগে এর পরিমাণ ছিল ৩৫.৮৪ শতাংশ। বিবিএস জরিপে আরো বলা হয়েছে, দেশের মোট আয়ের দুই-তৃতীয়াংশের মালিক ওপরের দিকে থাকা ৩০ শতাংশ মানুষ।</p>