<p>বাবা নেই। বড় তিন ভাই দিনমজুর এবং তিনজনেরই সংসার আছে। তাঁদের দেওয়া সামান্য অর্থেই কোনো রকমে চলে কিশোর গৌরাঙ্গ চন্দ্র রায় ও তার বিধবা মায়ের জীবনযাপন। এ ছাড়া অসুখ-বিসুখসহ নানা সংকটে পড়লে বড় ভাইরাও সব সময় সহায়তা করতে পারেন না। ফলে মাঝেমধ্যে কাজে যেতে হতো গৌরাঙ্গকেও। ফলে অভাব-অনটনের মধ্যে গৌরাঙ্গের লেখাপড়ার খরচ মেটানো কঠিন হয়ে পড়ে। এরপরও গৌরাঙ্গের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি দারিদ্র্য। শেষ পর্যন্ত দারিদ্র্য জয় করেই এবার এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছে সে।</p> <p>এই গৌরাঙ্গ চন্দ্র রায়ের বাড়ি নীলফামারীর ডোমার উপজেলার জোড়াবাড়ী ইউনিয়নের মিরজাগঞ্জ গ্রামে। এবার দিনাজপুর বোর্ডের অধীন বিজ্ঞান বিভাগে ডোমারের মিরজাগঞ্জ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল সে।</p> <p>জানা গেছে, অর্ধাহার-অনাহার ছিল গৌরাঙ্গের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু নিজের কষ্টকে আমলে নেয়নি সে। যত মনোযোগ ছিল লেখাপড়ায়। এখন সে দেখছে ভালো কোনো কলেজে পড়ে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু দারিদ্র্য সেই সাধ পূরণ হতে দেবে কি না, তা নিয়ে চিন্তিত সে ও তার বিধবা মা।</p> <p>জন্মের পর থেকেই গৌরাঙ্গ দেখেছে পরিবারের অভাব-অনটন। বাবার সামান্য দিনমজুরির আয়ে চলত পাঁচ ভাই ও দুই বোনের সংসার। দুই বছর আগে হারিয়েছে সে বাবা দীনেশ চন্দ্র দেবসিংহকে।</p> <p>গৌরাঙ্গ জানায়, অভাবের কারণে বাবার পক্ষে সম্ভব হয়নি তার বড় তিন ভাই ও দুই বোনকে লেখাপড়া করানো। তবে অভাব-অনটনের মধ্যেই তার চতুর্থ ভাইকে লেখাপড়া করাতে পেরেছিলেন বাবা। বর্তমানে সেই ভাই মেডিক্যালে পড়ছেন। গৌরাঙ্গের ওই ভাইয়ের নাম গোপাল চন্দ্র দেবসিংহ। তিনিও অভাব-অনটনের বাধা অতিক্রম করে বর্তমানে অধ্যয়ন করছেন দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজে শেষ বর্ষে। বড় ভাইকে অনুসরণ করে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে গৌরাঙ্গও।</p> <p>তবে অভাবের কারণে গৌরাঙ্গের লেখাপড়ায়ও ছন্দঃপতন ঘটে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝড়ে পড়েছিল সে; কিন্তু ইচ্ছা ছিল অদম্য। তাই পরে ব্র্যাক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পঞ্চম শ্রেণি পাস করতে সক্ষম হয় সে। এরপর ভর্তি হয় মিরজাগঞ্জ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে। এ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায় গৌরাঙ্গ।</p> <p>গতকাল এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর গৌরাঙ্গের বাড়িতে ছিল প্রতিবেশীদের ভিড়। চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও তার সাফল্যে প্রসংসা সবার মুখে। সন্তানের সাফল্যে মিষ্টির ঢল নামে অনেকের পরিবারে। কিন্তু গৌরাঙ্গের ভাগ্যে তা জোটেনি। অসহায় মা তাকিয়ে আছেন ছেলেদের দিকে। বড় তিন ছেলে এ মুহূর্তে দিনমজুরের কাজে আছেন নোয়াখালীতে।</p> <p>জিপিএ ৫ কী, তা জানা নেই গৌরাঙ্গের মা সৌধা রানী রায়ের। বাড়িতে শুভাকাঙ্ক্ষীদের ভিড়ে শুধু বুঝতে পারেন ভালো ফল করেছে ছেলে। এরপরও তার চোখে-মুখে বিষণ্নতার ছাপ। কথায় প্রকাশ করেছেন নিজের অসহায়ত্ব। অনেক কষ্টে এক ছেলেকে পড়াচ্ছেন মেডিক্যাল কলেজে। এখন আরেক ছেলের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করবেন কিভাবে। এই মা বললেন, ‘মুই তো লেখাপড়া জানো না। ওইটা (জিপিএ ৫) যে কী, বুঝিবার পারেছ না।’</p> <p>গৌরাঙ্গ জানায়, তার বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাকে প্রাইভেট পড়িয়েছেন বিনা বেতনে। একই সঙ্গে পড়ার জন্য বিভিন্ন বই-খাতা ও কলম দিয়ে সহযোগিতা করেছেন তাকে। ভালো ফলের জন্য রাত জেগে পড়েছে বাড়িতে। এমন সাফল্যে শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞ সে।</p> <p>গ্রামের ইউপি সদস্য মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘গৌরাঙ্গ আমার প্রতিবেশী। ছোটবেলা থেকেই সে মেধাবী। দারিদ্র্যের বাধা অতিক্রম করে সে এবার ভালো ফল করেছে। তার আরেক ভাই পড়ছে মেডিক্যালে। আশা রাখি গৌরাঙ্গের সাধও পূরণ হবে।’</p>