<p>যৌন হয়রানির মতো জঘন্য অপরাধ প্রতিকারে সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় কোনোভাবেই এই অপরাধের লাগাম টানা যাচ্ছে না। অপরাধের জন্য কাউকে নির্দিষ্ট আইনে নির্দিষ্ট শাস্তিও দেওয়া যাচ্ছে না।</p> <p>যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ২০০৯ সালে উচ্চ আদালত কয়েক দফা নির্দেশনা দেন। এরপর ২০১০ সালের আগস্ট মাসে ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আইন’ নামে একটি নতুন আইন করার সুপারিশ করে বাংলাদেশ আইন কমিশন। আইনের একটি খসড়া প্রণয়ন করে তা আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে জমাও দেওয়া হয়। কিন্তু প্রায় সাড়ে আট বছরেও এ আইনটি প্রণয়নে সরকারি পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।</p> <p>জানা গেছে, আইন কমিশন ও জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি কয়েক মাস ধরে কাজ করে খসড়াটি প্রস্তুত করেছিল। ২০১০ সালের ২৫ আগস্ট সেটি আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়।</p> <p>বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা সেই খসড়া জমা দেওয়ার পর আইন প্রণয়নের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত সবার সঙ্গে দফায় দফায় যোগাযোগ করেছি, যাতে আইনটি প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু সবাই প্রতিশ্রুতি দিলেও তা কাজে আসেনি।’</p> <p>বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, একটি আইন প্রণীত হয় জাতীয় সংসদে। এ রকম নতুন আইন নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনার ফলে সেটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ সচেতন হয়। ফলে আইনের প্রয়োগ সম্পর্কেও সব শ্রেণির নাগরিকরা অবগত হতে পারে। আর এ রকম হলে এ ধরনের অপরাধও কমিয়ে আনা সম্ভব।</p> <p>জানতে চাইলে গতকাল শুক্রবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ রকম আইন করা সময়ের দাবি। বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের বিবেচনায় রয়েছে। এ ধরনের আইন প্রণয়নে আইন মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। আমরা এ নিয়ে শিগগিরই আলোচনা করব। আশা করি দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ রকম আইন প্রণয়ন সম্ভব হবে।’</p> <p>এ বিষয়ে তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এসংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। ২০১০ সালে আইন কমিশন একটি ভালো প্রস্তাব দেয়। একই সঙ্গে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আইনের খসড়াও আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিল কমিশন। আইন মন্ত্রণালয় সেটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করে। এরপর বিষয়টি নিয়ে কেউ এগোয়নি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে।’</p> <p>সাবেক এ মন্ত্রী আরো বলেন, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ২০০৯ সালে উচ্চ আদালত কয়েক দফা নির্দেশনা দেন। নির্দেশনায় বলা হয়, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টের নির্দেশনাই আইন হিসেবে বিবেচিত হবে। সে সময় আইন মন্ত্রণালয় হাইকোর্টের ওই নির্দেশনাসংবলিত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে, যা আইনসম।</p> <p>আইন কমিশনের তখনকার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড. এম শাহ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, যৌন হয়রানি বিষয়ে ভারত ও পাকিস্তানের প্রণীত বিল ও আইনের আলোকে সে সময় খসড়াটি প্রস্তুত করা হয়েছিল। প্রস্তাবিত আইনটির উদ্দেশ্য হলো, কর্মস্থলে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেকোনো ধরনের হয়রানিমুক্ত নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করা। যাতে নারী-পুরুষ সবাই সম্মানের সঙ্গে কাজ করতে পারে এবং সুষ্ঠু পরিবেশে জ্ঞানার্জন ও কাজ করতে পারে। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে যৌন হয়রানিমূলক কিছু কর্মকাণ্ড ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে এ ধরনের অপরাধ দমনে কার্যকর ফল আসছে না। কেননা দণ্ডবিধির প্রচলিত শাস্তি অপেক্ষা কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলাভঙ্গজনিত প্রশাসনিক শাস্তি ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অধিক গ্রহণযোগ্য।</p> <p>ড. শাহ আলম বলেন, খসড়া আইনে যৌন হয়রানির সংজ্ঞা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। তা ছাড়া কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ আইনে উল্লিখিত অন্যান্য প্রয়োজনীয় শব্দের সংজ্ঞাও দেওয়া হয়েছে। এ আইনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা অনুসারে অভিযোগ কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। অভিযোগ কমিটির সদস্য কারা হবেন বা আইনটি কার্যকর হওয়ার কত দিনের মধ্যে অভিযোগ কমিটি গঠন করতে হবে তা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। প্রস্তাবিত খসড়া আইনে কারা, কখন, কিভাবে অভিযোগ করতে পারে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোগ কমিটি কী কী পদক্ষেপ নেবে তা বলা হয়েছে। যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রচলিত আইনে অপরাধ হিসেবে গণ্য হলে অভিযোগ কমিটির দায়িত্ব কী হবে তা-ও সুস্পষ্ট করা হয়েছে। যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযোগ কমিটি ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কী কী করণীয়, খসড়া আইনে তার বিধানের কথা বলা হয়েছে। খসড়া আইনে মিথ্যা মামলা বন্ধের জন্য শাস্তির বিধানও রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে অভিযোগের অনুসন্ধান চলাকালে ভুক্তভোগী বা অভিযোগকারীর নিরাপত্তার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযোগের গুরুত্ব ও প্রকৃতি ভেদে লঘু ও গুরু শাস্তি এবং ভুক্তভোগীর জন্য জরিমানা আদায়ের বিধি সংযুক্ত করা হয়েছে।</p>