<p>গত বছর হয়ে যাওয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার বাঁশগাড়ী এলাকায় আওয়ামী লীগের দুই নেতার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় গুলিতে একজন নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হন আরো তিনজন। এ ছাড়া দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে আহত হয়েছে আরো অন্তত ২১ জন। বেশ কয়েকটি বাড়ি ভাঙচুরের পাশাপাশি ১৫টি বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে।</p> <p>গতকাল বুধবার বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের বাঁশগাড়ী ও আশপাশের কয়েকটি গ্রামে দুপুর ১২টা থেকে সংঘর্ষ শুরু হয়। সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় বাঁশগাড়ীর বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে সংঘর্ষ চলছিল। শতাধিক দাঙ্গা পুলিশ ঘটনাস্থলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে উপজেলা প্রশাসন ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে।</p> <p>নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে উপজেলার চরাঞ্চল নিলক্ষা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দুই নেতার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ চলে আসছে। সেখানকার পরিস্থিতি শান্ত হতে না হতেই এবার রণক্ষেত্রে পরিণত হলো পাশের ইউনিয়ন বাঁশগাড়ী।</p> <p>সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তির নাম শারফিন মিয়া (২০)। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার সলিমগঞ্জ গ্রামের মজিবুর রহমানের ছেলে।</p> <p>পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন জানায়, গত বছরের ৭ মে বাঁশগাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের আগে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে ইউনিয়ন ও উপজেলা শাখা আওয়ামী লীগের দুই নেতার মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী ছিলেন বাঁশগাড়ী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হাফিজুর রহমান সাহেদ সরকার। কিন্তু স্থানীয় সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজুল হকের নাম কেন্দ্রে প্রস্তাব করেন। এ ঘটনা নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। সাহেদ সরকার দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। নির্বাচনের আগে-পরে দুই পক্ষের কয়েক দফা সংঘর্ষে দুজন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে অর্ধশত লোক।</p> <p>সিরাজুল হক আবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ায় এবং সংঘর্ষে দুজন মারা যাওয়ার পর থেকে সাহেদ সরকারের ২০০ থেকে ৩০০ সমর্থক এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়।</p> <p>স্থানীয় লোকজন জানায়, প্রায় এক বছর সাহেদ সরকার ও তাঁর সমর্থকরা নরসিংদীসহ বিভিন্ন স্থানে ছিল। কয়েক দিন ধরে তারা আবার নিজেদের বাড়িঘরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ খবর পেয়ে সিরাজুল হকের সমর্থকরা এলাকায় ব্যাপক বোমাবাজি করে। তারা মেঘনা নদীর তীরের বিভিন্ন স্থানে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে দল বেঁধে পাহারা দিতে থাকে। এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার তারা নিলক্ষা, চরমধুয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর ও বাঞ্ছারামপুর এলাকা থেকে ভাড়াটে লাঠিয়াল ও আগ্নেয়াস্ত্রধারী লোকজন নিয়ে চরমধুয়া  জোড়বিলসহ বিভিন্ন এলাকা দিয়ে বাঁশগাড়ীতে আসার চেষ্টা করে। এ খবর জানাজানি হওয়ার পর গতকাল সকালে এলাকায় দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয়।</p> <p>পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল দুপুর ১২টার দিকে চারটি গ্রামের দুই পক্ষের পাঁচ থেকে সাত হাজার লোক টেটা-বল্লম ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে বাঁশগাড়ী, চরমেঘনা, বটতলীকান্দি, বালুয়াকান্দি, চান্দেরকান্দি ও দিঘলিয়াকান্দি গ্রামে। সংঘর্ষকারীরা বেশ কয়েকটি বাড়িঘরে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। আগুন দেয় কমপক্ষে ১৫টি বাড়িতে।</p> <p>সংঘর্ষে চারজন গুলিবিদ্ধ হওয়াসহ কমপক্ষে ২৫ জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ শারফিন মিয়া, মাসুদ মিয়া ও ইউপি সদস্য আমির হোসেনকে নরসিংদী সদর হাসপাতালে এবং কাউছার, নূর মোহাম্মদ, রহিম বাদশা, নাহিদ, ইসমাইল ও মাসুদ নামের অন্য ছয়জনকে নরসিংদী সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদের মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শারফিনের মৃত্যু হয়।</p> <p>জেলা হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. মিজানুর রহমান জানান, হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ তিনজনকে আনা হয়েছে। শারফিনের মাথায় গুলি লেগেছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। বাকি দুজনের অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় তাঁদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।</p> <p>আহত ইউপি সদস্য আমির হোসেন বলেন, চেয়ারম্যান সিরাজুল হকের লোকজন হঠাৎ করেই তাঁদের ওপর হামলা চালায়। হামলাকারীরা তাঁদের ভিটামাটি সব কিছুই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। </p> <p>আহত আরেকজন জাহিদুল ইসলাম বলেন, সংঘর্ষে টেটার পাশাপাশি বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়া হয়েছে। পালানোর সময় তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।</p> <p>এ ব্যাপারে কথা বলতে এক পক্ষের নেতৃত্ব দেওয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হাফিজুর রহমান সাহেদ সরকারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।</p> <p>অন্য পক্ষের নেতৃত্ব দেওয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল হক বলেন, ‘সাহেদ আমাদের সবাইকে মেরে ফেলতেছে। অনেক লোক আহত হয়েছে। আমরা জীবন বাঁচানোর চেষ্টা চালাচ্ছি।’</p> <p>রায়পুরা থানার ওসি (তদন্ত) মাজাহারুল ইসলাম বলেন, আধিপত্য ও নির্বাচনী  সহিংসতার জের ধরেই এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। ১০ থেকে ১৫টি বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ফাঁকা গুলি, টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ব্যবহার করেছে।</p> <p>ওসি বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার পর এ ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।</p> <p>রায়পুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, ‘উভয় পক্ষ আক্রমণাত্মক। এই অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। কিন্তু ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে দুই পক্ষই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে।</p> <p>এর আগে একই উপজেলার নিলক্ষা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের দুই নেতার সমর্থকদের মধ্যে প্রায় এক মাস ধরে দফায় দফায় সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত এবং শতাধিক লোক আহত হয়।</p>