<p>ভাষাসৈনিক, পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলাকে অন্যতম ভাষা হিসেবে সরকারি স্বীকৃতির দাবি উত্থাপনকারী, বরেণ্য রাজনীতিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে গুলি করে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীর কুমিল্লার ৫৩ ব্রিগেডের ১১৭ এফআইও ইউনিটের সুবেদার আশরাফ খান (আশরূপ)। ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল বিকেলে তাঁকে হত্যার আগে চালানো হয়েছিল নির্মম নির্যাতন। দেওয়া হয়েছিল বৈদ্যুতিক শকও। ইউনিটের মেজর সেলিম খানের নির্দেশে ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের পশ্চিম পাশে পাহাড়ের ওপর গর্ত করে এর পাশে দাঁড় করিয়ে তাঁকে গুলি করে হত্যা করেছিল আশরাফ। একই জায়গায় আরো বহু বিশিষ্ট বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে।</p> <p>স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী কুমিল্লা সেনানিবাসের তৎকালীন নরসুন্দর (নাপিত) রমণী মোহন শীলের মৃত্যুর আগে লিখে যাওয়া বর্ণনায় এসব তথ্য জানা গেছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ওই সেনানিবাসে পাকিস্তানি সেনাদের একমাত্র নরসুন্দর ছিলেন তিনি। সেনারা প্রথমে তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিল, কিন্তু পরে নিজেদের প্রয়োজনেই বাঁচিয়ে রেখেছিল। পুরো সেনানিবাসে তাঁর যাতায়াতের স্বাধীনতা ছিল। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও অনেক তথ্য তিনি মুক্তিবাহিনীর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পরলোকগমন করেন তিনি। কিন্তু এর পাঁচ-ছয় বছর আগে থেকেই তিনি ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দেখা কুমিল্লা সেনানিবাসের কিছু ঘটনার প্রত্যক্ষ বিবরণ লিখে গেছেন। তাঁর একমাত্র ছেলে রাখাল চন্দ্র শীলের কাছে রয়েছে সেই অমূল্য দলিল।</p> <p>মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ বুদ্ধিজীবীসহ অন্য অনেক বিশিষ্টজনের কী পরিণতি হয়েছিল, পরে তার অনেকটাই জানা গেলেও ভাষাসংগ্রামী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের শেষ পরিণতির বিষয়টি ৪৫ বছর ধরেই অজানা ছিল। শুধু ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পরিণতিই নয়, রমণী মোহন শীলের লেখনীতে উঠে এসেছে কুমিল্লার দায়িত্বে থাকা ২৩ এফএফ ও ২২ বেলুচের সমন্বয়ে গঠিত ৫৩ ব্রিগেড গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান লে. কর্নেল ইয়াকুব মালিককে ২৫ মার্চের পর থেকে আটকে রাখা এবং ২৯ মার্চ বাঙালি সেনা সদস্যরা বিদ্রোহ ঘোষণার পর আটক ১৭ জন বাঙালি অফিসারসহ ৯১৫ জনকে কিভাবে জবাই ও গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, সেই বর্ণনাও।</p> <p>এ তালিকায় থাকা কুমিল্লার জেলা প্রশাসক এ কে এম শামসুল হক ও পুলিশ সুপার কবির উদ্দিনকে সরিয়ে এফআইওর সুবেদার ক্লার্ক নূর হোসেন তাঁদের ১৭ বেলুচ রেজিমেন্টের কোয়ার্টারে আটক কুমিল্লা ইস্পাহানি পাবলিক স্কুলের ১২ শিক্ষকের সঙ্গে একঘরে রাখে। পরে শিক্ষকদের সঙ্গে তাঁদেরও হত্যা করা হয়।</p> <p>ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি অ্যারমা দত্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একাত্তরের ২৯ মার্চ রাত দেড়টায় কুমিল্লা শহরের ধর্মসাগর পাড়ের (শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সড়ক) বাড়ি থেকে আমার দাদু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও কাকু দীলিপ দত্তকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন বোখারি। এ সময় দীলিপ দত্তের পায়ে গুলি করা হয়েছিল। একটি জিপ, পাঁচটি ট্রাক ও একটি অ্যাম্বুল্যান্স এসে দাদু আর কাকুকে ধরে কুমিল্লা সেনানিবাসে নিয়ে যায়। তার পর থেকে আমরা তাঁদের আর কোনো খোঁজ পাইনি।’</p> <p>অ্যারমা দত্ত বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পর যখন কুমিল্লা সেনানিবাসে বধ্যভূমিগুলো আবিষ্কৃত হয়, তখন নরসুন্দর রমণী শীল দাদুকে দেখার কথা সাংবাদিকদের বলেছিলেন। কিন্তু কিভাবে হত্যা করা হয়েছে বা কারা কখন, কোথায় হত্যা করেছে, তা তিনি বলেননি।’ অ্যারমা জানান, ১৯৯০ সালের দিকে তিনি একবার রমণী শীলের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।</p> <p>প্রয়াত রমণী মোহন শীলের ছেলে রাখাল চন্দ্র শীল কালের কণ্ঠকে বলেন, “বাবা যখন চট্টগ্রামে মিলিটারি একাডেমিতে ‘বারবার’ ঠিকাদার ছিলেন তখন একটু একটু করে সেসব ঘটনা লিখে দিতেন। আর আমি চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ে একজন টাইপ রাইটারকে দিয়ে তা টাইপ করে রাখতাম। টাইপ হওয়ার পর বাবার হাতের লেখা ছিঁড়ে ফেলতে বলতেন, আমি ছিঁড়ে ফেলতাম। এই লেখাগুলো তিনি কাউকে দেননি। শুধু বলেছেন, ‘তোর কাছে একটি জিনিস রেখে গেলাম।’”</p> <p>রমণী মোহন শীলের বাড়ি কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার হরিণধরা গ্রামে। তাঁর বাবা কৈলাশ চন্দ্র শীল। তিনি ১৯২৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার ২৫ বছর আগে থেকে তিনি কুমিল্লা সেনানিবাসে চাকরি করতেন। এক ছেলে ও সাত মেয়ে নিয়ে থাকতেন সেনানিবাসের কোয়ার্টারেই। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তাঁর ছেলে রাখাল চন্দ্র পালিয়ে ভারতে চলে যান। সে সময় রাখালের বয়স ছিল ৯ বছর।</p> <p>রমণী মোহন শীল লিখে গেছেন, কুমিল্লা সার্কিট হাউসে ১১৭ এফআইও ইউনিটের অস্থায়ী কার্যালয় ছিল। কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে সেখানে ধরে আনা হতো বিশিষ্ট বাঙালিদের। তাঁদের সার্কিট হাউস থেকে আনা হতো সেনানিবাসের ১৭ বেলুচ রেজিমেন্টের কোয়ার্টার ঘাটে। সেখানে চালানো হতো নির্মম নির্যাতন। ওই বেলুচ রেজিমেন্টের কোয়ার্টার ঘাটে আটককৃতদের ৮ এপ্রিল রাতে এফআইও ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর তাঁদের ওপর চালানো হয় নির্যাতন। নরসুন্দরের কাজ করায় তাঁকে পাকিস্তানি সেনারা নিয়ে যায় ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের এফআইও ক্যাম্পে। ৯ এপ্রিল সকালে সেখানে তিনি এফআইও সুবেদার আশরাফ খানসহ (আশরূপ) কয়েকজন হাবিলদারের দাড়ি কাটেন। এ সময় বাঙালিদের নির্যাতনের দৃশ্য দেখে তিনি বাড়িতে চলে আসেন। বিকেল ৩টায় তাঁকে আবার সেখানে নেওয়া হয়। তিনি দেখতে পান স্কুলের পশ্চিম পাশে পাহাড়ের ওপর এফআইওর সদস্যরা ও কিছু রাজাকার বহু গর্ত করছে। পাহাড়ের চারপাশে পাকিস্তানি সেনারা পাহাড়া দিচ্ছে। একপর্যায়ে স্কুলের বিভিন্ন কক্ষে আটকে রাখা ব্যক্তিদের এনে গর্তের কাছে দাঁড় করিয়ে গুলি করে গর্তে ফেলে দেওয়া হয়। আর বেলচা দিয়ে মাটি কেটে তাঁদের ঢেকে দেওয়া হয়। ১১৭ এফআইও ইউনিটের মেজর সেলিম খানের নির্দেশে বিকেল ৫টার দিকে এই হত্যাযজ্ঞ চলে।</p> <p>রমণী মোহন শীল লিখেছেন, ‘কুমিল্লার বড় অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র বাবুকে বাড়ি থেকে ধরে কুমিল্লা সেনানিবাসের সিকিউরিটি ব্রাঞ্চে আনা হয়। এরপর বাবুকে বহু ধরনের মারধর করা হয়। এমনকি কারেন্টের শকও দেওয়া হয়। বাবুকে দুই দিন ব্রিগেড অফিসে আনা-নেওয়ার সময় তাঁর সমস্ত গায়ে ক্ষতবিক্ষত দাগ দেখেছি। ওই সব ক্ষতে আয়োডিন দিয়ে তুলা লাগিয়ে মাথা ব্যান্ডেজ করে রাখা হয়েছিল। নিজের চোখে দেখেছি সিকিউরিটি ব্রাঞ্চের (স্কুলের) পশ্চিম পাশে সুবেদার আশরূপ (আশরাফ খান) বাবুকে গুলি করে হত্যা করে।’</p> <p>রমণী মোহন শীল লিখেছেন, “আমি স্কুলের পেছনে একজন জল্লাদের দাড়ি কাটছিলাম। ওই সময় ধীরেন্দ্র বাবু আমাকে বলে, ‘বাবু, আমি প্রস্রাব করব কোথায়?’ আমি মুখে না বলে আঙুলের ইশারায় বাবুকে বাথরুম দেখিয়ে দেই। ওই সময় জল্লাদ বাহিনী আমাকে চোখ রাঙিয়ে বলে, ‘তুমি ওইদিকে তাকাচ্ছ কেন?’ এরপর আর বাবুর দিকে তাকানোর সাহস পাইনি। বাবু অনেক কষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে বাথরুমের চারটি সিঁড়ি উঠানামা করেন। তার কিছুক্ষণ পর বাবুকে স্কুলের পশ্চিম পাশে নিয়ে সুবেদার আশরাফ সাহেব গুলি করে হত্যা করেন।”</p> <p>জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের পর সুবেদার আশরাফ খানের বিরুদ্ধে কোলাবরেটরস স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়েছিল, যার নম্বর ১৯/৭৪। তিনি পাকিস্তানি ১৯৫ জন শীর্ষ সামরিক যুদ্ধাপরাধীদের একজন।</p> <p> </p>