<p>মিয়ানমারের মংডু এলাকায় নির্যাতন ও বর্বরতার মাত্রা বাড়িয়েছে সেনাবাহিনী। গত ৯ নভেম্বর কঠোর অভিযান শুরুর পর ২২-২৪ নভেম্বর মাত্রা কিছুটা কমানো হয়েছিল। কিন্তু শুক্রবার রাতে মংডুর হাতিপাড়ায় তাণ্ডব চালানো হয়। পরদিন শনিবার তাণ্ডব চালানো হয় আশপাশের পাড়াগুলোতেও।</p> <p>এবার তথাকথিত অভিযানে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে—নারীদের জড়ো করে বিবস্ত্র অবস্থায় বসিয়ে রাখা হচ্ছে। যুবতীদের প্রকাশ্যে ধর্ষণ করার অভিযোগও পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে বাসরত রোহিঙ্গারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছে, শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়া অং সান সু চির সরকার শান্তির এই নমুনা দেখাচ্ছে!</p> <p>মংডুর বাসিন্দারা জানিয়েছে, শুক্রবার সকালে নতুন করে অভিযান শুরুর পর হাতিপাড়ার ১৯ জন পুরুষকে আটক করা হয়। তাদের মধ্যে ছয়জনের লাশ পাওয়া গেছে। তারা হলো জাহাঙ্গীর (১৭), নূর খান (১৬), আবদুল হাফেজ (৭০), সেলিম (১৮), ইউসুফ (১৮) ও রফিক (১৬)। যারা পালিয়ে বাঁচতে পেরেছে পরে তারা লাশগুলোর সন্ধান পায় এবং দাফন করে। ৯ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে তারা জেনেছে। অন্যদের খোঁজ মেলেনি। তাদের হত্যা করা হয়েছে বলে স্থানীয়দের আশঙ্কা। ঝোপ-জঙ্গলে নিখোঁজ ব্যক্তিদের লাশের সন্ধান করছে তারা।</p> <p>হামলার সময় গুলিবিদ্ধ হয় পাঁচজন। তারা হলো নুরুল আমিন (১৮), তার ভাই ছৈয়দুল আমিন (১৫), মৌলভি মোস্তফা কামাল (৪০), মোহাম্মদ ইয়াহিয়া (৩০) ও তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী তরমিল ফাতেমা (১০)।</p> <p>স্থানীয় লোকজন জানায়, অভিযানের সময় বাড়িঘরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ তো নিয়মিত ঘটনা। নতুন হামলার পর হাতিপাড়া, বলিপাড়া, মরিংকং, কুয়ারবিল, সারিপ্রাং, নুরুল্লাহপাড়া ও কিয়ারিপ্রাং এলাকার অনেক নারীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আগে পুরুষরা নিখোঁজ হতো। এখন যুবতীরা নিখোঁজের তালিকায় স্থান পাচ্ছে।</p> <p>কালের কণ্ঠ’র এই প্রতিবেদকরা বিশেষ ব্যবস্থায় মংডু এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে যোগাযোগ করতে সমর্থ হন। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা হয়। কয়েকজন বাসিন্দার মোবাইল ফোনে ধারণ করা কিছু ভিডিও ফুটেজ ও স্থিরচিত্র কালের কণ্ঠ’র কাছে এসেছে। সমস্যা হচ্ছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভয়ে রোহিঙ্গারা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে পারছে না। বিশেষ ব্যবস্থায় মাঝেমধ্যে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে। প্রাপ্ত ভিডিও ও স্থিরচিত্র পর্যালোচনা করে বোঝা যায়, সেখানে আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী।</p> <p>নারীদের এক জায়গায় জড়ো করে বিবস্ত্র অবস্থায় বসিয়ে রাখা বা প্রকাশ্যে ধর্ষণের কথা শুনে হতাশ ও ক্ষুব্ধ বাংলাদেশে বাসরত রোহিঙ্গারা। তাদের একজন টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত ক্যাম্পের চেয়ারম্যান দুদু মিয়া। তিনি বলেন, ‘পুরুষদের হত্যা ও যুবতীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। নারীদের বিবস্ত্র করে প্রকাশ্যে বসে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে।’</p> <p>ক্ষুব্ধ দুদু মিয়া বলেন, ‘শান্তির জন্য মিয়ানমার সরকারের উপদেষ্টা অং সান সু চি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী। নারী হয়েও তিনি রোহিঙ্গা নারীদের প্রকাশ্যে ধর্ষণ বা বিবস্ত্র করার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। এটা কিভাবে সম্ভব?’ তিনি বলেন, ‘এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, তাণ্ডবে তাঁর সায় রয়েছে। নারীর ইজ্জত রক্ষায় শান্তির নেত্রী সু চি এগিয়ে আসছেন না, এটা কি বিশ্ববিবেক দেখছে না?’</p> <p>মংডুর স্থানীয় সূত্র থেকে জানা গেছে, শুক্রবার ভোরে অভিযানের সময় নারীদের এক স্থানে জড়ো করে খোলা আকাশের নিচে বসিয়ে রাখা হয়। অনেককে বিবস্ত্র করে রাখা হয়। পুরুষদের বেধড়ক পেটানো হয়, ধরেও নিয়ে যাওয়া হয়। তরুণীদেরও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। মায়ের সামনে মেয়েকে বা মা-মেয়েকে একই স্থানে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে।</p> <p>মংডুর প্রত্যক্ষদর্শীদের মাধ্যমে হামলার ঘটনার ভিডিও বা স্থিরচিত্র পাওয়া খুবই কঠিন। সেনাবাহিনী তাণ্ডব চালিয়ে যাওয়ার পর স্থানীয়রা তাদের মোবাইল ফোনে কিছু দৃশ্য ধারণ করতে পারছে। এ রকম প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন কালের কণ্ঠ’র কাছে কিছু স্থিরচিত্র ও ভিডিও ফুটেজ পাঠিয়েছেন। তিনি সৌদি আরবে তাঁর স্বজনদের কাছে পাঠানোর জন্য এগুলো ধারণ করেন। তিনি জানান, সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে তাণ্ডবের ছবি তোলার চেষ্টা করেননি তিনি; পালিয়ে বেঁচেছেন।</p> <p>একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেল, একটি স্থানে ৪০-৪৫ জন নারী বসে আছে। তারা আকুতি জানাচ্ছে। এক নারীর কণ্ঠে তাদের বোমা মেরে হত্যার আশঙ্কার কথা শোনা গেল।</p> <p>আরেকটি ভিডিও ফুটেজে এক বৃদ্ধাকে বলতে শোনা গেল, তাঁর মেয়ে সুন্দরবাশিকে হাত বেঁধে ‘জুলুম’ করা হয়েছে। পাড়ার সবাইকে ঘিরে রেখে আগুন দেওয়া হয়েছে। তিনি মেয়েকে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে আনতে চেয়েছিলেন; কিন্তু মিলিটারির (মিয়ানমার সেনাবাহিনী) তাড়ায় সেটা সম্ভব হয়নি।</p> <p>গত ২৬ নভেম্বর হাতিপাড়ায় আগুন দেওয়ার একটি ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে। সহায়-সম্বল রক্ষায় সেখানকার মানুষের চেষ্টার দৃশ্য দেখা গেল তাতে। একটি শিশুর কণ্ঠে হারিচ নামের একজনকে ডাকতে শোনা গেল; কিন্তু হারিচের সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। আগুনের কুণ্ডলী থেকে একটি শিশুকে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে আসতেও দেখা গেল।</p> <p>২৬ নভেম্বর দিনে ধারণ করা আরেকটি ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, হাতিপাড়া থেকে আতঙ্কিত নারী-শিশু ও অন্য লোকজন পালাচ্ছে। একজনকে বলতে শোনা গেল, ‘কাছে এসেছে।’ এরপরই গুলির শব্দ শোনা গেল। আর লোকজন প্রাণ রক্ষার্থে ছুটতে শুরু করল।</p> <p>হাতিপাড়া থেকে শুক্রবার ধরে নিয়ে যাওয়া বৃদ্ধ আলমকে পাওয়া যায় পরদিন। তিনি জানান, তাঁদের পিছমোড়া করে বেঁধে বেধড়ক পেটানো হয়েছে। ৯ জনকে ওই দিন ছেড়ে দেওয়া হয়। একজনকে রেখে দেওয়া হয়।</p> <p>ওপার থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, তরমিল ফাতেমার পায়ে এখনো গুলি রয়েছে। গুলিবিদ্ধদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন সেখানকার পল্লী চিকিৎসকরা। একজন বলেন, ‘আমাদের এখানে সরকারি চিকিৎসক তেমন নেই। হাতে গোনা যারা আছে, তারা রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা করে না। এ ছাড়া ভয়েও তাদের কাছে কেউ চিকিৎসা নিতে যায় না। তাই পল্লী চিকিৎসকদের কাছেই যেতে হয়। তারা যত দূর সম্ভব চিকিৎসা দেয়।’</p> <p>একজন বাসিন্দা জানান, শুক্রবার সকালে সেনাবাহিনীর লোকজন ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়, গরু-ছাগলসহ মূল্যবান সব কিছু লুট করে নিয়ে যায়। নারীদের প্রকাশ্যে গণধর্ষণ করে। তাদের প্রকাশ্যে মাঠে বিবস্ত্র করে বসে থাকতে বাধ্য করে তারা। অনেক মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে। তাদের কোথায় রাখা হয়েছে এখনো তাঁরা নিশ্চিত হতে পারেননি।</p> <p>ছয় নৌকা বোঝাই রোহিঙ্গাকে ফেরত তাণ্ডবের মুখে টিকতে না পেরে অনেক রোহিঙ্গা সীমান্তের ফাঁক গলে বাংলাদেশে ঢুকছে। টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। গতকাল রবিবার অনিবন্ধিত লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে জানা গেছে, সেখানে শনিবার থেকে গতকাল ভোর পর্যন্ত শতাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী আশ্রয় নিয়েছে। ক্যাম্পের চেয়ারম্যান দুদু মিয়া জানান, গত ৯ নভেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত এক হাজার ৩৩৮ জন অনুপ্রবেশকারী সেখানে আশ্রয় নিয়েছে।</p> <p>এদিকে ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবু জার আল জাহিদ গতকাল সংবাদ সম্মেলনে জানান, শনিবার রাতে রোহিঙ্গা নাগরিক বোঝাই ছয়টি নৌকা নাফ নদ থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনুপ্রবেশ বন্ধে বিজিবি কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করছে বলে তিনি জানান।</p> <p>৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এমরান উদ্দিন সরকার জানান, তাঁরা পাঁচজন রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।</p>