<p>শেরশাহ ভারতবর্ষের সম্রাট ছিলেন (১৫৪০-১৫৪৫)। তাঁর জন্ম ১৪৭২ খ্রি.। প্রকৃত নাম ফরিদ। পিতা হাসান খান শূর। বিহারের সুলতান বাহার খান লোহানি তাঁর সাহস ও বীরত্বের জন্য তাঁকে ‘শের খান’ খেতাবে ভূষিত করেন। শেরশাহ ‘শূর’ বংশের প্রতিষ্ঠাতা। ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে শূরি সাম্রাজ্যের জয়যাত্রা সূচিত হয়।</p> <p>১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে শের খান বাংলা আক্রমণ করে সুলতান মাহমুদ শাহকে পরাজিত করেন। কিন্তু সম্রাট হুমায়ুনের বাহিনী অগ্রসর হলে শের খান বাংলা ত্যাগ করেন। ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে চৌসার যুদ্ধে (বক্সারের সন্নিকটে) হুমায়ুুনকে পরাজিত করে শের খান ‘শাহ’ উপাধি ধারণ করেন এবং বাংলা পুনর্দখল করেন। পরিচিত হন শেরশাহ নামে।</p> <p>পরের বছর শেরশাহ সম্রাট হুমায়ুনকে পরাজিত ও বিতাড়িত করে দিল্লির সিংহাসন অধিকার করেন। শেরশাহ তাঁর শাসনকাঠামোকে ৪৭টি প্রাদেশিক সরকারে এবং সব প্রদেশকে কয়েকটি পরগনায় বিভক্ত করেন। তিনি বাংলাকে ১৯টি প্রশাসনিক ইউনিটে বিভক্ত করেন। প্রশাসনিক প্রয়োজনে প্রাদেশিক সরকারগুলোতে দুজন করে অতি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়োগ করেন।</p> <p>তাঁরা হলেন :</p> <p>শিকদার-ই-শিকদারান (মুখ্য শিকদার),</p> <p>মুন্সিফ-ই-মুন্সিফান (মুখ্য মুন্সিফ)।</p> <p>তাঁরাই তদারক করতেন—আমিন, মুন্সিফ, পাটোয়ারি, চৌধুরী, মুকাদ্দাম, কারকুন প্রমুখ পরগনা কর্মকর্তাদের। সেই সময়ে ব্যবস্থা করা হয় ভূমি জরিপ, রাজস্ব আদায় ইত্যাদিরও। শেরশাহ প্রথম পাট্টা (ভূমিস্বত্বের দলিল), কবুলিয়াত (চুক্তি দলিল) প্রথা চালু করে জমির ওপর রায়ত বা প্রজার মালিকানা নিশ্চয়ন এবং কৃষিঋণের ব্যবস্থা করেন।</p> <p>শেরশাহর সহজ মুদ্রানীতির ফলে ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতি হয়। তিনি পুলিশি ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করেন। তিনি গ্রামপ্রধানদের দায়িত্ব দেন নিজ নিজ এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বিধানের। মুহতাসিবদের সহায়তায় তিনি মদপান ও ব্যভিচার দমন করেন। তিনি গড়ে তোলেন শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও একদল দক্ষ গুপ্তচর।</p> <p>শেরশাহ ছিলেন দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতের প্রধান। তাঁর অধস্তন বিচারকদের বলা হতো কাজি-উল-কুজ্জাত। পরগনাগুলোতে কাজি ফৌজদারি মামলার বিচার করতেন। দেওয়ানি মামলার বিচারক ছিলেন আমিন। সংখ্যালঘুদের বিরোধ ফায়সাল করতেন পঞ্চায়েত প্রধানরা।</p> <p>ধর্মপ্রাণ শাসক হিসেবে শেরশাহর সুনাম ছিল। তিনি সংখ্যালঘুদের প্রতি ছিলেন উদার ও সহানুভূতিশীল। শেরশাহর জনহিতকর কার্যক্রমে তৈরি হয়েছিল—মসজিদ, মাদরাসা, লঙ্গরখানা, গুরুত্বপূর্ণ ইমারত, হাসপাতাল ইত্যাদি।</p> <p>শেরশাহ তাঁর শাসনামলে একটি প্রাচীন সড়ক সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে ‘সড়ক-ই-আজম’ নাম দেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল, সড়কটি মক্কা-মদিনা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা। অথচ শেরশাহর শাসনামল ছিল স্বল্পস্থায়ী; পাঁচ বছর মাত্র।</p> <p>বিভিন্ন শাসনামলে শেরশাহর সড়কটি নানা নামে পরিচিত ছিল, যেমন—শাহ রাহে আজম, সড়কে আজম, বাদশাহি সড়ক, উত্তরের পথ ইত্যাদি। সড়কটি চট্টগ্রাম থেকে সোনারগাঁ হয়ে যশোর পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া, দিল্লি ও পাকিস্তানের পেশোয়ারের মধ্যে দিয়ে আফগানিস্তানের কাবুল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।</p> <p>২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক উপমহাদেশের পূর্ব ও পশ্চিমাংশে সেতুবন্ধ রচনা করে। সড়কটি রাজধানী আগ্রার সঙ্গে প্রত্যন্ত এলাকার যোগাযোগ নিশ্চিত করে। উদ্দেশ্য ছিল, প্রশাসনিক গতিসঞ্চার এবং পূর্বে সোনারগাঁ, পশ্চিমে দিল্লি ও লাহোর হয়ে মুলতান, দক্ষিণে বোরহানপুর এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে যোধপুরের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া।</p> <p>সড়কটি সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষা সুবিধার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মকর্তাদের যাতায়াত, ডাক যোগাযোগ, তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সড়কটির দুই ক্রোশ দূরে দূরে অতিথিশালা, বিশ্রামাগার, সরাইখানা নির্মিত হয় এবং ছায়াদানকারী বৃক্ষসারি ছিল দুই পাশে।</p> <p>ব্রিটিশরা সামরিক যোগাযোগ ও ডাক যোগাযোগের প্রয়োজনে সড়কটি কলকাতা থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত সম্প্রসারণ করে এবং নাম দেয় ‘গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড’।</p> <p>বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তানে ‘মুসলিম ঐতিহ্য-স্মারক : শেরশাহ সড়ক’ এশিয়ান হাইওয়ে হিসেবে সমাদৃত। বাংলাদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে আঞ্চলিক মহাসড়ক হিসেবে। সড়কটি যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলা হয়ে মাগুরার শালিখা উপজেলার শরুশুনা, শতপাড়া, দেশমুখপাড়া ও বুনাগাতির মধ্য দিয়ে মহম্মদপুর উপজেলার নহাটা ইউনিয়ন হয়ে ফরিদপুরের মধ্য দিয়ে ঢাকার সোনারগাঁ পর্যন্ত বিস্তৃত।</p> <p> </p> <p>লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান</p> <p>ইসলামিক স্টাডিজ কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ</p> <p>কাপাসিয়া, গাজীপুর</p> <p> </p>