মহানবী (সা.) হিজরত করার আগে মাগরিব ছাড়া বাকি চার ওয়াক্তে ফরজ নামাজ ছিল দুই রাকাত করে। হিজরতের পর মুকিম (নিজ এলাকায় অবস্থান করছে এমন) ব্যক্তির জন্য জোহর, আসর ও এশার নামাজ চার রাকাত করা হয়। একটা সময় পর্যন্ত নামাজের সময় হলে মানুষ অনুমান করে মসজিদে উপস্থিত হতো। তাদের নামাজের প্রতি আহ্বানের কোনো বিধিবদ্ধ নিয়ম ছিল না।
বিজ্ঞাপন
রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের সঙ্গে নামাজের প্রতি আহ্বান জানানোর বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করেন। তারা নামাজের সময় হলে আগুন জ্বালানো, পতাকা উত্তলন, শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়া ও ঘণ্টা বাজানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু বিষয়গুলো মহানবী (সা.) পছন্দ করলেন না। কেননা আগুন জ্বালানো ও পতাকা উত্তোলনের বিষয়টি ঘুমন্ত ব্যক্তির কোনো কাজে আসবে না। আর শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়া ইহুদিদের রীতি এবং ঘণ্টা বাজানো খ্রিস্টানদের নিয়ম হওয়ার কারণে তা গ্রহণ করা সম্ভব হলো না। তখন ওমর (রা.) বললেন, নামাজের ঘোষণা দেওয়ার জন্য তোমরা কি একজন লোক পাঠাতে পারো না? তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে বেলাল, উঠো এবং নামাজের ঘোষণা দাও। তবে কি বলে আওয়াজ দেওয়া হবে তা চূড়ান্ত হলো না। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০৪; আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা, পৃষ্ঠা ৩০১)
মহানবী (সা.)-এর ইচ্ছা ও সাহাবিদের মতামতের ব্যাপারে চূড়ান্ত ফয়সালা আসে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। এক বিস্ময়কর পদ্ধতিতে আজানের শব্দমালা চূড়ান্ত হয়। হাদিসে এসেছে, মহানবী (সা.)-এর পরামর্শ সভায় উপস্থিত সাহাবিদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ (রা.) নামে একজন সাহাবি ছিলেন। তিনি রাসুল (সা.)-এর চিন্তার কথা মাথায় নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। অতঃপর স্বপ্নে তাকে আজান শিখিয়ে দেওয়া হলো। বর্ণনাকারী বলেন, পরদিন ভোরে তিনি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বিষয়টি অবহিত করে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমি কিছুটা তন্দ্রাছন্ন অবস্থায় ছিলাম। এমন সময় এক আগন্তুক এসে আমাকে আজান ও (ইকামত) শিখিয়ে দিলেন। বর্ণনাকারী বলেন, একইভাবে ওমর (রা.)ও ২০ দিন আগেই স্বপ্নেযোগে আজান শিখেছিলেন। কিন্তু তিনি কারো কাছে তা ব্যক্ত না করে গোপন রেখেছিলেন। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ স্বপ্নের বৃত্তান্ত বলার পর তিনিও তাঁর স্বপ্নের কথা রাসুল (সা.)-কে জানালেন। রাসুল (সা.) বললেন, তুমি আগে বললে না কেন? তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ (রা.) এ বিষয়ে আমার আগেই বলে দিয়েছেন। এ জন্য আমি লজ্জিত। রাসুল (সা.) বললেন, বেলাল, ওঠো এবং আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ তোমাকে যেরূপ নির্দেশ দেয় তুমি তাই করো। অতঃপর বেলাল (রা.) আজান দিলেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বপ্নযোগে প্রাপ্ত আজানকেই চূড়ান্ত করেন এবং শরয়িভাবে তার প্রচলন ঘটান। আজান দেওয়ার এই মহান খেদমত বেলাল ইবনে রাবাহ হাবশি (রা.)-কে সোপর্দ করেন। তিনি ছিলেন ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন। বেলাল (রা.) ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মুয়াজ্জিন’ উপাধিতে ভূষিত হন এবং কিয়ামত পর্যন্ত আগত সব মুয়াজ্জিনের ইমাম হওয়ার অনন্য গৌরব অর্জন করেন। (নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা ২০৬)
আজানের দার্শনিক ভিত্তি ও তার মর্মকথা সম্পর্কে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি (রহ.) বলেন, ‘আজান প্রচলনের মধ্যে আল্লাহর হিকমত হলো আজান শুধু আহ্বান ও ঘোষণাই থাকবে না; বরং তা দ্বিনের একটি স্থায়ী চিহ্ন ও রীতিনীতি হয়ে থাকবে। তা এভাবে যে যখন প্রত্যেকের সামনে আজান দেওয়া হবে, তখন তাতে দ্বিনের সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। আর লোকেরা তা মেনে নেওয়া তাদের পক্ষ থেকে আল্লাহর দ্বিনের আনুগত্য প্রমাণ হবে। এ জন্য আজান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে আরম্ভ করা হয়। অতঃপর ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস তাওহিদ ও রিসালাতের ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর ইসলামের মৌলিক ইবাদত নামাজের দিকে আহ্বান করা হয়। তার সঙ্গে সঙ্গে নামাজের উপকারিতাও বর্ণনা করা হয়। যাতে আজানের উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে সবার সামনে প্রতিভাত হয়ে যায়। ’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ : ২/২৯৮)