<p>আমাদের জীবন-জীবিকার জন্য কৃষি, শিল্প, খনি, বন ইত্যাদি যা-ই বলি না কেন, সব কিছুর মূল উৎস ভূমি। পবিত্র কোরআনে ভূমির প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের পৃথিবীতে ক্ষমতার অধিকারী করেছি এবং তাতে তোমাদের জন্য যাবতীয় জীবনোপকরণ সৃষ্টি করেছি। আসলে তোমরা কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ১০)</p> <p>অন্যত্র তিনি বলেন, ‘তিনিই (আল্লাহ) তোমাদের জন্য ভূমিকে অনুকূল করে দিয়েছেন। সুতরাং তার বুকের ওপর দিয়ে চলাচল করো এবং তার দেওয়া জীবিকা থেকে আহার করো।’ (সুরা মুলক, আয়াত : ১৫)। আল্লাহ আরো বলেন, ‘সালাত শেষ হলে তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) সন্ধান করো।’ (সুরা জুমআ, আয়াত : ১০)</p> <p><strong>ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমি </strong></p> <p>আল-কোরআনে ভূমি ও অন্য অস্থাবর জিনিসের ওপর ব্যক্তি মালিকানা স্বীকৃত। ব্যক্তি উত্তরাধিকার, ক্রয়, দান, অসিয়ত (উইল), গনিমত, ভাড়া, শুফআ ইত্যাদি আইনের মাধ্যমে মালিকানা লাভ করতে পারে। উত্তরাধিকার সূত্রে কারা কার সম্পত্তির কতটুকু মালিক হবে, তা আল-কোরআনের সুরা নিসায় সুন্দরভাবে বর্ণিত আছে। ব্যক্তিগত ভূমির মালিক ভূমির ব্যাপারে যথেষ্ট স্বাধীন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা খাও, পান করো; কিন্তু অপচয় কোরো না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৩১)</p> <p>নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, অন্যের ক্ষতিও করবে না।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৩৪০-৪১)</p> <p>সুতরাং জমির অপচয় ও অন্যের ক্ষতি না করে নিজের জমি চাষাবাদ, বনায়ন, পুকুর খনন, দোকান-পাট, বাড়ি-ঘর, শিল্প কারখানা নির্মাণ, ইজারা বা ভাড়া প্রদান, দান, হেবা, ওয়াকফ, অসিয়ত ইত্যাদি যেকোনো কিছু করতে পারে। ইচ্ছা করলে মালিক নিজে চাষ করতে পারে।</p> <p>ব্যক্তি মালিকানায় লাভের আরেক ধরনের জমি আছে, যাকে আরবিতে ‘মাওয়াত’ বলে। যেসব জমি অনাবাদি, পানির অভাবে, পানিতে ডুবে থাকা কিংবা অন্য কোনো কারণে চাষযোগ্য না হওয়ায় তা এমনিতে পড়েছিল, সেসব জমিকে মাওয়াত বা অনাবাদি জমি বলে। এমন জমি যে ব্যক্তিই প্রথমে আবাদযোগ্য করে তুলবে সে-ই তার মালিক হবে। চর, দ্বীপ ইত্যাকার জমি এ দেশে ‘মাওয়াত’ শ্রেণিভুক্ত হতে পারে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অনাবাদি ভূমি আবাদ করবে সে ওই জমির মালিক হবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩০৭৩-৭৪)</p> <p><strong>সরকারি ভূমি </strong></p> <p>সরকারের রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে জমি-জায়গা থাকতে পারে—থাকা আবশ্যকও। সরকারি অফিসাদির স্থান, চারণভূমি, সড়ক, রেলপথ, পানিপথ, সেনানিবাস, পার্ক, খেলার স্থান, পুকুর, খাল, বিল, বাজার ইত্যাদির জন্য সরকারের জমির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। একটি রাষ্ট্র গড়ে ওঠার সময়ই তার চৌহদ্দিতে অবস্থিত সমুদ্র, নদ-নদী, হাওর-বাঁওড়, বিল, হ্রদ, পাহাড়-পর্বত, বন-বনানি, নদীতে জেগে ওঠা নতুন চর, নতুন দ্বীপ ও মরুভূমি রাষ্ট্রের মালিকানাধীন জমিতে পরিণত হয়। কোনো ব্যক্তি এগুলোর মালিক থাকে না। অনুরূপভাবে যুদ্ধের  মাধ্যমে গড়ে ওঠা দেশে বিজিত শক্তি দেশ ছেড়ে চলে গেলে তাদের রেখে যাওয়া ভূসম্পত্তি, কলকারখানা, বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট ইত্যাদিও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে পরিণত হয়। এ ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনার স্বার্থে সরকার জনগণের কাছ থেকে উচিত মূল্যে জমি কিনে রাষ্ট্রীয় কাজে তা ব্যবহার করতে পারে। প্রত্যেক রাষ্ট্র তা করেও থাকে। নবী করিম (সা.) বনু কায়নুকা, বনু নাজির, বনু কুরায়জা থেকে গনিমত, খুমুস ও ফাই হিসেবে যে সম্পত্তি পেয়েছিলেন, তা মদিনার মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছিলেন। খায়বারের সম্পত্তিকে তিনি তথাকার ইহুদি চাষিদের মধ্যে উৎপন্ন ফসলের অর্ধেকের বিনিময়ে চাষ করতে দেন। (বুখারি, হাদিস : ২৩৩৮)</p> <p>আবু বকর (রা.)-এর আমলে ভূমি ব্যবস্থাপনার একই ধারা বজায় ছিল। পরবর্তীকালে ওমর (রা.)-এর সময়ে তৎকালীন পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যের এক বিরাট এলাকা ইসলামী খেলাফতের অধীনে আসে। মিসর থেকে গোটা ইরান পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগে ইসলামের প্রসার ঘটে। তিনি ভূমি ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনেন। তিনি প্রকৃত চাষিদের হাতে জমির মালিকানা ছেড়ে দেন। তারা জমি চাষ করবে এবং জমির ফসল থেকে অথবা প্রচলিত মুদ্রায় খারাজ বা ভূমিকর আদায় করে (ইসলামের অর্থনীতি, পৃষ্ঠা ১৪৭-৪৮)। আরেক ধরনের ভূমি আছে, যার প্রত্যক্ষ মালিক রাষ্ট্র নয়। কিন্তু তত্ত্বাবধান সূত্রে সে পরোক্ষ মালিক। এসব জমি সাধারণ বা সমষ্টির কল্যাণে দানকৃত জমি। যেমন ওয়াকফ, মসজিদ, মাদরাসা, গোরস্তান, ঈদগাহ, ধর্মীয় এসব প্রতিষ্ঠানের নামে দানকৃত জমি ইত্যাদি। অমুসলিমদের উপাসনালয় ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দানকৃত ভূমিও এই শ্রেণিভুক্ত। এসব ভূমি থেকে সরকার নিয়মমাফিক ওশর ও খারাজ আদায়ের পর দানের উদ্দেশ্যমাফিক বাকি অর্থ ব্যয় হচ্ছে কি না তা তত্ত্বাবধান করবে।</p> <p>রাষ্ট্র উল্লিখিত কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি কিংবা দানকৃত সম্পত্তি অন্য কাউকে প্রদান করার এখতিয়ার রাখে না। এমন কিছু করলে তা জুলুম ও অবৈধ দখল বলে গণ্য হবে। চাষাবাদযোগ্য জমি ব্যক্তিগত হলে তা চাষ করতে হাদিসে বারবার বলা হয়েছে। যেমন সহিহ মুসলিমে বলা হয়েছে, ‘জমি হয় তোমরা নিজেরা চাষ করো, নয় অন্যকে চাষ করতে দাও।’ (বুখারি, হাদিস : ২৩৩৯)</p> <p>ইসলামে ভূমির ওপর জমিদারি প্রথা স্বীকার করা হয়নি এবং উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সবার জন্য ভূমিতে অধিকার থাকায় কেউ ভূমির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় না। কেউ ভূমিহীন হলে মাওয়াত কিংবা সরকারি সম্পত্তি থেকে তার ভূমি লাভের সুযোগ আছে।</p> <p> </p>